স্টাফ রিপোর্টার: বোরো ধানের ভরা মরসুমেও চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। চালভেদে এক লাফে তিন থেকে চার টাকা দাম বেড়েছে। এ নিয়ে একমাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ছয় দফায় শস্যভান্ডার-খ্যাত কুষ্টিয়া ও দিনাজপুরে চালের দাম কেজিপ্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। দফায় দফায় চালের দাম বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠেছে ক্রেতাদের। সবার এখন একটায় প্রশ্ন চালের দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে সব ধরনের চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের সব জায়গায় এর প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অটো মিল মালিকরা চাল মজুদ করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ অভিযোগকে পাত্তা না দিয়ে মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে টানা বৃষ্টি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ঝড়ো হাওয়ায় ধান নষ্টের কারণে বাড়ছে চালের দাম। এদিকে চালের বাজার অস্থিতিশীলের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। মিলারদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘বাজারে নতুন চাল এখনো আসছে না। বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তা গত বছরের পুরনো চাল। তাহলে নতুন ধান কোথায় যাচ্ছে?’ সাধারণত মৌসুম শুরু হলে চালের দাম অনেকটাই কমে যায়। স্বস্তি পায় মানুষ। এ মৌসুমে দাম কমে যাওয়ার কারণ হলো, বোরোতে দেশের মোট চালের প্রায় ৫৫ শতাংশ উৎপাদিত হয়। বিপুল সরবরাহ দাম কমিয়ে দেয়। কিন্তু এবারই দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। নতুন মৌসুমের চাল বাজারে এসে যখন দাম কমার কথা, তখনই সরবরাহ কম, বাড়ছে দাম। গত দুই দিনে মোটা চালের তুলনায় চিকন চালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। যে মিনিকেট চাল ৫৩ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হতো, তা এখন ৬৪-৬৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া শম্পাকাটারি ৫২ থেকে ৫৪ টাকা বিক্রি হলেও, এখন তা ৬৪-৬৫ টাকা, আঠাশ জাতের চাল ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা বিক্রি হলেও তা বেড়ে ৫৩-৫৫ টাকা ও স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৩৮-৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৬-৪৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দিনাজপুরের পাশাপাশি কুষ্টিয়ায় এক লাফে চালের দাম ৩ টাকা বেড়েছে। এ নিয়ে ছয় দফায় গত এক মাসেরও কম সময়ে কুষ্টিয়ায় চালের দাম কেজি প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। অটো রাইস মিলে ভাঙানো মিনিকেট চাল ৬৬-৬৭ টাকা কেজি, সাধারণ মিনিকেট ৬৪ টাকা, অটো রাইস মিলে ভাঙানো কাজললতা চাল ৫৭ টাকা ও কাজললতা সাধারণ ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাসমতি ৭৬ টাকা থেকে ৮০ টাকায়, সাধারণ বাসমতি ৭৬ টাকা, কাটারিভোগ ৭২ টাকা, নাজিরশাইল ৭৮ টাকা ও পাইজাম চাল ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। শুধু দিনাজপুর-কুষ্টিয়া নয়, সারা দেশেই বেড়েছে চালের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে মিনিকেট, নাজিরশাইল ও মোটা চালের দাম বস্তাপ্রতি ১৪০ থেকে ১৯০ টাকা বেড়েছে। পাইকারিতে দাম বাড়ার কারণে খুচরা পর্যায়ে কেজিতে গড়ে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। গত দুই-তিন দিনের ব্যবধানে ২ টাকা বেড়ে মিনিকেট চালের কেজি হয়েছে ৬২ থেকে ৬৬ টাকা। বিআর-২৮ ও পায়জাম জাতীয় চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫৩ টাকায়। মোটা চালের (স্বর্ণা ও গুটি জাতের) কেজিতেও দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। এই চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৬ টাকায়; যা তিন দিন আগেও কেনা গেছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকায়। পুরাতন সরু জাতের চালের দর বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এক কেজি কাটারি, নাজির বা মিনিকেট চাল কিনতে খরচ হচ্ছে ৮০ টাকা। নন শর্টার বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকায়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-মিলার ও মৌসুমি ধান ব্যবসায়ীদের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বড় ব্যবসায়ীরা অবৈধ মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। তারা নিজেরাই সিন্ডিকেট করে নিয়ন্ত্রণ করছেন ধান ও চালের বাজার। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম লায়েক আলী বলেন, ‘হাওরে ধান উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষকরা ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। কৃষকদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। এখনো ৫ শতাংশ চাল ওঠেনি কৃষকের ঘরে। আমরা মিলগেটে চাল বিক্রি করি সরকার নির্ধারিত রেটেই। আমরা কোনো দাম বাড়াইনি। এর ভাউচার ও রিসিট সবই আছে। তবে ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে চালের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চোখ-কান খোলা রেখে বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চালকল মালিকদের একজন নেতা বলেন, ‘চালের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হলো ধানের দাম বৃদ্ধি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে খাদ্য সংকট তৈরি হবে বলে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। যে কারণে অনেকেই ভাবছেন দেশে চালের সংকট তৈরি হবে। সে কারণে অনেকে অবৈধ মজুদ করছেন। এ ছাড়া টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে চাল না পাওয়ার গুজব, সরবরাহে সংকটের আশঙ্কায় প্রয়োজনের বেশি মজুদ করা, বাঁধ ভেঙে হাওরে ধানের ক্ষতি, সিলেটের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা এবং ঘন ঘন কালবৈশাখীর ছোবলে ধানের ক্ষতি- ইত্যাদি কারণে চালের দাম বেড়েছে।’
চালের দাম বাড়ার এসব কারণের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘গত বছরও এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ভরা মৌসুমে যেখানে ধান-চালের দাম কমার কথা, সেখানে উল্টো বাড়ছে। আমার ধারণা চালের সরবরাহ পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়বে- এমন শঙ্কা থেকে ভরা মৌসুমে বাজারে চালের দাম বাড়তে পারে। সরবরাহে ঘাটতির আশঙ্কায় অনেকে ধান চাল মজুদ করে থাকতে পারে। সেদিকেও সরকারের খেয়াল রাখাটা খুব জরুরি।’
এদিকে কোনোক্রমেই চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে দেয়া হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। গতকাল রোববার সচিবালয়ে ‘বোরো ২০২২ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং সংক্রান্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায়’ ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ধান কিনে মজুদ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। সবাই প্রতিযোগিতা করে ধান কিনছে, ভাবছে ধান কিনলেই লাভ। অধিকাংশ মিল মালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও তারা উৎপাদনে যাচ্ছেন না। এ অবস্থা চলতে দেয়া হবে না। কে কত পরিমাণ ধান কিনছেন ও কে কত পরিমাণ চাল ক্র্যাসিং করে বাজারে ছাড়ছেন- তা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের রিপোর্ট আকারে দিতে হবে। ‘ভারত থেকে গম দেয়া বন্ধ হচ্ছে’ এমন গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। অথচ শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অনেক দেশ গম দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশকে চিঠি পাঠিয়েছে। কেউ চালের বাজার অস্থিতিশীলের চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।