বোরো ধানের উৎপাদন বাড়াতে ১৭০ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা
আউশ ও আমনের বাম্পার ফলনেও কমেনি চালের দাম : সার ও ডিজেলের মজুতসহ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা
২৭ লাখ কৃষক পাচ্ছেন বিনামূল্যে সার ও বীজ
স্টাফ রিপোর্টার: কয়েক মাস ধরে বিশ্বমন্দার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। আগামী বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা খাদ্যসংকট নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যে একাধিকবার উঠে এসেছে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ। আউশ ও আমনের বাম্পার ফলনেও কমেনি চালের দাম। বাজার স্থিতিশীল ও আলোচিত মন্দা মোকাবিলার আগাম সতর্কতা হিসেবে বোরো উৎপাদন বাড়াতে জোর দিচ্ছে সরকার। এজন্য ১৭০ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে কৃষকদের। এর মধ্যে বোরোর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২৭ লাখ কৃষক বিনামূল্যে পাবেন বীজ ও সার। এ ছাড়াও উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদে ১২ লাখ কৃষক পাবেন ৮২ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা। এদিকে, বোরো মরসুমকে সামনে রেখে বাড়ানো হয়েছে সার ও ডিজেলের পর্যাপ্ত মজুদ এবং সেচ কাজে নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। দেশে এখন বোরো ধান আবাদের প্রস্তুতি চলছে। এজন্য প্রয়োজন সার, বীজ ধান ও সেচের। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে বোরো আবাদে সেচের জন্য বিদ্যুতের পিক পিরিয়ড। সরকার এ সময়ে প্রয়োজনে শহরে লোডশেডিং করে সেচের জন্য গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে ডিজেল ও সার পাচার রোধে বিজিবিসহ সীমান্ত এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। বোরো উৎপাদনে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংস্থা একসঙ্গে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে মনিটরিং সেল খোলা হচ্ছে। মাঠ ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হচ্ছে। মাঠ তদারকির জন্য কর্মকর্তাদের তালিকা করার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে তিন কোটি ৫০ লাখ টন চাল ও ৫০-৬০ লাখ টন আটার চাহিদা রয়েছে। চালের প্রায় শতভাগ এবং গমের ১০ শতাংশের মতো দেশীয় জোগান থেকে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলছেন। সবশেষ ১৯ ডিসেম্বর সোমবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএইউ) গাজীপুরের ২৫তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস এবং প্রযুক্তি প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যেও একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। এ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘দেশ ইতোমধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভালো মানের ও উর্বর জমি হারিয়েছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং আবাসনের কারণে বিপুল পরিমাণ উর্বর আবাদি জমি হারিয়ে গেছে, কারণ, পূর্ববর্তী সরকারগুলো এতে মনোযোগ দেয়নি। আমরা এ ধরনের জমি আর হারাতে চাই না এবং সে কারণেই আমরা এটি সংরক্ষণের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি।’ এর আগেও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার নিজ নিজ এলাকায় খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য আরও উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। ১৭ অক্টোবর ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ উপলক্ষে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আবারও অনুরোধ করছি, কোনো খাদ্যের যেনো অপচয় না হয়। পাশাপাশি যার যেখানে যতটুকু জমি আছে, তা চাষের আওতায় এনে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ান। সারাবিশ্বে যে দুর্যোগের আভাস আমরা পাচ্ছি, তা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করুন। আমি বিশ্বাস করি, সবার প্রচেষ্টায় এটা করা সম্ভব।’ কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বোরোর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রায় ৮২ কোটি টাকার প্রণোদনা পাবেন ১৫ লাখ কৃষক। এতে কৃষখরা বিনামূল্যে ২ কেজি ধানবীজ পাবেন। উচ্চ ফলনশীল জাতের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রায় ৭৩ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় উপকারভোগী কৃষক হচ্ছে ১২ লাখ। এতে একজন কৃষক ১ বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে পাবেন। এছাড়া, সমলয়ে বা কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের সুবিধার্থে একটি মাঠে একই সময়ে ধান লাগানো ও কাটার জন্য ১৫ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এর আওতায় ৬১টি জেলায় ১১০টি ব্লক বা প্রদর্শনী স্থাপিত হবে। প্রতিটি প্রদর্শনী হবে ৫০ একর জমিতে, খরচ হবে ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাত থেকে এ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে এসব প্রণোদনা বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এবার উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানের আবাদ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন করে ৫৩ হাজার হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা হয়েছে। হাওড় অঞ্চলে আগাম বন্যার আশঙ্কা বিবেচনায় রেখে আগাম জাতের ধান উৎপাদনে জোর দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কৃষিবিষয়ক পরামর্শক কৃষিবিদ ডক্টর শহীদুল ইসলাম জানান, চালের মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টানতে এবং বৈশ্বিক যে মহামন্দার খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা মোকাবিলার জন্য সরকার আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত আছে এবং মাঠেও রয়েছে প্রচুর খাদ্যশস্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশে দুর্ভিক্ষ হলেও বাংলাদেশে তা হবে না। সরকারের এই প্রণোদনা সময় উপযোগী এবং কৃষকদের উৎসাহ যোগাবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আমন ধানে লাভ পেয়ে এবার তীব্র শীত উপেক্ষা করে বোরো আবাদে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন কৃষক। ধানের এলাকা হিসেবে খ্যাত হাওড় অঞ্চলে চলছে বোরো আবাদের ধুম। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, মাগুরা, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ও কৃষকরা প্রচন্ড শীত ও হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে বোরো ধান রোপণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসেবে দেশে বছরে ২৬ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে বোরো মরসুমে প্রয়োজন হয় প্রায় ৭ লাখ টন। এবার বোরো উৎপাদন বাড়াতে সরকার পর্যাপ্ত ডিজেল মজুত করেছে। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বছরে দেশে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বোরো মরসুমের জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ১৪ লাখ টন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় ৩ লাখ ৯৬ হাজার টন। ফেব্রুয়ারিতে ৪ লাখ ১৫ হাজার টন আর মার্চ মাসে প্রয়োজন হয় প্রায় আড়াই লাখ টন। ইতোমধ্যে সরকার বোরো মরসুমের জন্য ১৭ লাখ টন সার মজুত করেছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে, বোরো মরসুমে দেশে ডিজেলচালিত ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুতে চলে এক লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদ্যুতে চলে এক লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদ্যুতে চলে। সরকার বিদ্যুৎচালিত পাম্পে ২০ শতাংশ করে ভর্তুকি দিচ্ছে। প্রয়োজনে সেচ কাজে ডিজেলেও ভর্তুকি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সরকার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫০ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে। এর মধ্যে হাইব্রিড ধানের চাষ হবে ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান আবাদ হচ্ছে ৪০ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। স্থানীয় জাতের ধান চাষ হবে ২৫ হেক্টর জমিতে।