বেসরকারি স্কুল-কলেজে নিয়োগ পেতেও লাগছে কমপক্ষে চার বছর
শিক্ষক ঘাটতি দ্রুত পূরণ না হওয়ায় পাঠদান ও শিক্ষার মানোন্নয়নে হচ্ছে ক্ষতি
স্টাফ রিপোর্টার: ২০১৯ সালের ২৩ মে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনের সার্কুলার প্রকাশ করা হয়। ১৯ জুন পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন নেয়া হয়। এতে ১১ লাখ ৭৬ হাজার প্রার্থী আবেদন করেন। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয় একই বছরের ৩০ আগস্ট। আর ফল প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। এতে ২ লাখ ২৮ হাজার ৪৪২ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। পরে লিখিত পরীক্ষা হয় একই বছরের ১৫ ও ১৬ নভেম্বর। লিখিত পরীক্ষার এক বছর পর ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর ফল প্রকাশ করা হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ২২ হাজার ৩৯৮ জন প্রার্থী। এই নিবন্ধনের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয় ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর। এই পরীক্ষা শেষ করতে সাত মাস সময় লেগে যায়। মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয় ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর। আর ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর ৬৮ হাজার ৩৯০ জন নিয়োগের জন্য চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। ২০১৯ সালের আবেদন করে উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীরা এখনো নিয়োগ পাননি। শুধু তা-ই নয়, এরও অনেক আগে ১৫তম, ১৪তম থেকে প্রথম নিবন্ধন প্রার্থীদের জন্য তিনটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল। ওই তিনটি গণবিজ্ঞপ্তিতে যারা সুপারিশপ্রাপ্ত হননি, তারাও চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছেন। ফলে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরির জন্য এক জনকে দীর্ঘ ১৪-১৫ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সমন্বয়হীনতা, নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদাসীনভাবে দেখা এসব কারণে এমনটি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া এনটিআরসিএর বেশি কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আদালতের দ্বারস্থ হন প্রার্থীরা। বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালতের মামলা চলমান থাকায়ও প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে সুপারিশ পেতে বিলম্ব হচ্ছে। ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনের সার্কুলার প্রকাশ পায় ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর। ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিল নেওয়া হয় প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ২০১৯ সালের জুলাইয়ে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ পায় ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর। ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে। ৩০ মার্চ ৩য় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং ১৫ জুলাই শূন্য পদের বিপরীতে প্রাথমিকভাবে ৩৮ হাজার ২৬৮ জন শিক্ষক প্রার্থীকে সুপারিশ করে এনটিআরসিএ। এই শিক্ষকরা নিয়োগ পান ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি। সময় লেগেছে প্রায় তিন বছরেরও বেশি সময়।তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে চূড়ান্ত সুপারিশের অপেক্ষায় আছেন ৩২ হাজার শিক্ষকপ্রার্থী। এর মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরম পূরণ করে অনলাইনে জমা দিয়েছেন। এইসব প্রার্থী কবে চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাবেন, তা জানেন না। পুরোটাই অনিশ্চয়তায় রয়েছেন তারা। রফিকুল ইসলাম নামে এক প্রার্থী বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার আশায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি। কিন্তু যারা প্রাথমিকভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদের এখনো চূড়ান্ত সুপারিশ করা হচ্ছে না। ফলে আমরা অনিশ্চয়তা আছি।’ আলমগীর নামে এক প্রার্থী বলেন, একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হতে যদি তিন বা চার বছর লেগে যায়, তাহলে এনটিআরসিএর অধীনে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতি উচ্চশিক্ষিতরা আস্থা হারাবেন। এনটিআরসিএর শিক্ষক নিয়োগে এ দীর্ঘসূত্রিতা উচ্চশিক্ষিত বেকারদের যেমন হতাশ ও নিরুৎসাহিত করছে, তেমনই শিক্ষক ঘাটতি দ্রুত পূরণ না হওয়ায় পাঠদান ও শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শিক্ষকরা বলছেন, ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য। এই শিক্ষকসংকটে ক্লাস হচ্ছে না নিয়মিত। অথচ শিক্ষক নিয়োগে বিলম্ব হচ্ছে। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে এনসিটিআরসিএর চেয়ারম্যান এনামুল কাদের খান গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেই এনেছিলাম। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার একটি আদালতের নির্দেশনা পেয়েছি, যেখানে এই প্রক্রিয়া ছয় মাসের জন্য আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে। আদালতের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।’ তিনি জানান, এনটিআরসিএর নিয়োগে বিলম্বের কারণে যারা নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন, তারা আদালতে গিয়ে রিট করেন। আদালত এই নিয়োগের পর স্থগিতাদেশ দেয়। এ কারণে আমরা কিছু করতে পারছি না। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা আপিল করে করছি।’ প্রার্থী নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে আবার সার্কুলারের জন্য অপেক্ষা করে, তিন-চার বছর সময় লাগে। সময় কমানোর উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আইন করতে হবে। যেখানে কিছু পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। সে লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছি।’ ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য সনদ দিত এনটিআরসিএ। এই সনদ থাকলেও নিয়োগের ক্ষমতা ছিল গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির হাতে। ২০১৫ সালে এই পদ্ধতির পরিবর্তন আনে সরকার। এর পর থেকে এই নিয়োগের পুরো ক্ষমতা চলে যায় এনটিআরসিএর কাছে। আর নিয়োগের দীর্ঘসূত্রিতায় বিপাকে পড়ছেন লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী।