বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি : বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে ক্রয়ক্ষমতা

গ্যাসের দাম আরও এক দফা বাড়ানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন : প্রভাব পড়বে সব খাতে

স্টাফ রিপোর্টার: আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে সরকার তড়িঘড়ি করে সব ধরনের সেবা ও পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। জুন থেকে গ্যাস, সার, জ্বালানি তেল ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বাড়ানো হলো খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি মাসেই সমন্বয় করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গ্যাসের দাম আরও এক দফা বাড়ানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পানির দামও বাড়ানোর কথাবার্তা চলছে। এসব পণ্যই কৃষি, শিল্প ও ভোক্তাপর্যায়ে ব্যবহৃত হয়। দফায় দফায় এগুলোর দাম বাড়ানোর ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে বৃদ্ধি পাবে মূল্যস্ফীতির হার। সব মিলে ক্রয়ক্ষমতা কমবে ভোক্তার। একই সঙ্গে বেড়ে যাবে জীবনযাত্রার ব্যয়, কমে যাবে মান।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ বা জ্বালানি তেল এসব পণ্য অর্থনীতির লাইফ লাইন। এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত। একটির দাম বাড়লে সব খাতে এর প্রভাব পড়ে। এজন্য কোন পণ্যের দাম কত বাড়লে কোন খাতে কি হারে পণ্য বা সেবার দাম বাড়বে এ ব্যাপারে নীতিমালা দরকার। তাহলে সব খাতে সমন্বয় থাকবে। এখনকার মতো বিচ্ছিন্ন ভাবে দাম বাড়ালে কোথাও শৃঙ্খলা থাকবে না।

সূত্র জানায়, করোনার কারণে ২০২০ সাল থেকেই বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। সেই মন্দা কাটিয়ে উঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দা আরও জাঁকিয়ে বসে। গত বছরের পুরোটিই গেছে মন্দা মোকাবেলায় ব্যয়সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিয়ে। চলতি বছর মন্দার ছোবল আরও কঠিন হবে বলে সতর্ক করেছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। মন্দা মোকাবেলায় তারা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা বাড়ানো, রাজস্ব আয় বাড়ানো ও ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এতে রিজার্ভে চাপ পড়েছে। রিজার্ভ বাড়াতে সরকার আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে। এই ঋণের শর্ত হচ্ছে ভর্তুকি কমাতে হবে। বাড়াতে হবে পণ্য ও সেবার দাম। এ কারণে ৫ জুন ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। ১ আগস্ট ইউরিয়া সারের দাম ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ১২ জানুয়ারি খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ। গত ৭ মাসে পাঁচ দফায় এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়ানোর ফলে ইতোমধ্যে সব খাতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে পণ্যের দাম, পরিবহণ ভাড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের খরচ। সব মিলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে আগস্টে সর্বোচ্ছ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ উঠেছিল। এরপর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ হার কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু আলোচ্য সময়ে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।

ভোক্তা পর্যায়ে নতুন করে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর ফলে সব খাতেই উৎপাদন খরচ বাড়বে। এবার গৃহস্থালি থেকে শুরু করে কৃষির সেচ, শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র শিল্প, নির্মাণ শিল্প, ধর্মীয়, শিক্ষা এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান, পানির পাম্প, ইলেকট্রিক যানের ব্যাটারি চার্জ, মাঝারি, বড়, ভারী শিল্প খাতে গড়ে ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাবে কৃষি উৎপাদনে সেচের খরচ বাড়বে। কেননা বর্তমানে সেচের সিংহভাগই বিদ্যুতের মাধ্যমে দেওয়া হয়। সব খাতের শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে বাড়বে পণ্যের দাম। বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারি চার্জেও খরচ বাড়ায় এর ভাড়াও বাড়তে পারে। পানির পাম্পের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে এর দামও বাড়বে। সব মিলে চাপ পড়বে ভোক্তার ওপর। ইতোমধ্যেই পণ্যের বাড়তি দামে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠেছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকে সঞ্চয়ে হাত দিয়েছেন। নতুন সঞ্চয়ও করতে পারছেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকে। প্রতিমাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসেই দাম বাড়বে। এতে ভোক্তার ওপর চাপও বাড়বে। প্রতিমাসে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পানির দামও বাড়াতে হবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সব মিলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ভোক্তার কাঁধে পড়বে বড় চাপ। মন্দায় আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে ভোক্তাকে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করতে হবে। এটি করলে খাবারে পুষ্টির মান কমবে। বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ এসব খাতে ব্যয় কমাতে হবে। ফলে ওইসব খাতে আরও মন্দা ভর করবে।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেছেন, চলতি বছর বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়বে খাদ্য পণ্যের দাম। এতে ভোক্তারা চাপে পড়বেন। এর মধ্যে গ্যাস, জ্বালানি তেলের পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং আরও বাড়ানো হবে এমন ঘোষণায় ভোক্তারা শঙ্কিত হয়ে পড়বেন। বাড়তি ব্যয় বহন করার মতো তাদের সক্ষমতা আছে কিনা সেটি সরকার বিবেচনায় নেয়নি। একতরফা ঘোষণার মাধ্যমে দাম বাড়িয়েছে। বিদ্যুতের এ বাড়তি দাম ভোক্তাকে ভোগাবে।

আগামীতে বিদ্যুতের দাম আর না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এ খাতে যে অপচয় ও দুর্নীতি হয় তা রোধ করতে পারলে ভর্তুকি অনেক কমে যাবে। সরকারকে দাম না বাড়িয়ে অপচয় বন্ধ ও দুর্নীতি রোধ করার দিকে নজর দেওয়ার ওপর জোর দিতে বলেন তিনি।

সূত্র জানায়-ডলারের দাম, জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম বাড়ানো ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্প পণ্যের দাম ইতোমধ্যেই ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে কৃষিপণ্যের দাম। আমদানি পণ্যের দাম তো লাগামছাড়া। এদিকে ভোক্তার আয় কমায় সার্বিকভাবে বিক্রি কমে গেছে। যে কারণে প্রায় সব ব্যবসায়ে মন্দা চলছে। এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ও আরও বাড়ানো হবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

এ প্রসঙ্গে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ মিলছে না। দাম বাড়ানোর কারণে যে হারে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। তারচেয়ে বেশি বাড়ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে। এতে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন কম হচ্ছে। অথচ শ্রমিক ও অন্যান্য খাতে খরচ কমছে না। ফলে রপ্তানি খাত তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কৃষিতে সংকট আরও বেশি। একদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচের খরচ বাড়বে। বাড়তি দামেও গ্রামে বিদ্যুৎ মিলছে না। ফলে সেচ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ সেচের বড় মরসুম চলছে এখন। মার্চ পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে গ্রামে লোডশেডিংও বেড়েছে। এছাড়া সারের তীব্র সংকট তো আছেই। আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষি উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় দেশেও এর দাম বেড়েছে। এদিকে ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে দাম আরও বাড়ছে।

সারা দেশেই বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহণ চলাচল করে। এগুলোর ব্যাটারি চার্জে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে ভাড়া বাড়ানোর একটি চাপ বাড়বে। এতে বাড়তি ভাড়া দিতে হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More