বিদ্যুতের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের মূল্য
দুই মাসে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপ বহন করছে সাধারণ মানুষ
স্টাফ রিপোর্টার: দুই মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে তিনবার। প্রতিবারই গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে শতকরা পাঁচভাগ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই মাসে ১৫ ভাগ বলা হলেও বাস্তবে তার চেয়ে বেশি বেড়েছে। তাদের কথায়, সরকার যে ভর্তুকির কথা বলছে, বাস্তবে তা ধোপে টেকে না। কারণ, এখন জ্বালানি তেল আর গ্যাসে ভর্তুকি দিতে হয় না। বিদ্যুতে কত ভর্তুকি দিতে হয়, তা স্পষ্ট নয়। আর ভর্তুকি দিতে হলেও বিদ্যুৎ খাতে অপ্রয়োজনীয় খরচের কারণে হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন। গত ১২ এবং ৩০ জানুয়ারি শতকরা পাঁচ ভাগ করে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। আর ২৮ ফেব্রুয়ারি আবারো পাঁচ ভাগ বাড়ানো হয়, যা ১ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে। বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, গ্রাহক পর্যায়ে সবচেয়ে কম ব্যবহারকারী শ্রেণিতে প্রতি ইউনিটের দাম চার টাকা ১৪ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে চার টাকা ৩৫ পয়সা। এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য, যাদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ৫০ ইউনিট, যারা একটি বা দুটি লাইট ও ফ্যান ব্যবহার করেন তাদের জন্য। পরের ধাপে চার টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে চার টাকা ৮৫ পয়সা। আর আবাসিক খাতে সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী গ্রাহকের ক্ষেত্রে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা। কৃষিকাজের সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম চার টাকা ৫৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে চার টাকা ৮২ পয়সা। সরকার চলতি বছর থেকে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ কমাতে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় শুরু করেছে। আর ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো।
রফিক রাফি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম এখন প্রতি মাসেই বাড়ছে। এখন তো আমার পরিবারের অবস্থা বিদ্যুতের দামের চাপের কারণে খুবই খারাপ। আগে আমার পরিবারে প্রতিমাসে বিদ্যুতে খরচ হতো তিন হাজার টাকা। এখন খরচ হবে চার হাজার টাকা। গরম এসে যাচ্ছে। বিদ্যুতের ব্যবহার আরও বাড়বে।’
তার কথায়, ‘বিদ্যুতের দামের সঙ্গে অন্য জিনিসের দামও বাড়ে। এরই মধ্যে মুরগির দাম বেড়ে গেছে। বাজারে তো আজকে (বৃহস্পতিবার) মুরগি নাই। অন্যান্য নিত্য পণ্যের দামও আবার বাড়তে শুরু করেছে। আমার সীমিত আয়ে এখন জিনিসপত্রের ব্যবহার কমিয়ে দিতে হবে।’
একই কথা বলেন আরেক চাকরিজীবী এস এম মিন্টু। তিনি বলেন, ‘আমার মাসিক দুই হাজার ৫০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল তিন হাজার ৫০০ টাকা হয়ে যাবে। আমি আমার পরিবার চালাতে হিমশিম অবস্থার মধ্যে পড়ে যাবো। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বাচ্চার স্কুল খরচ কীভাবে যে চালাবো জানি না।’ তার কথা, ‘মন্ত্রীরা এখনো বিদ্যুতের দাম সহনীয় বললেও আমার মতো যারা আছেন তাদের জন্য এটা কোনোভাবেই সহনীয় নয়। আমরা আসলে আরও চাপের মুখে পড়লাম।’
বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘এভাবে বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রফিট মার্জিন কমে যাচ্ছে। আমরা বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়ার কথা বলায় ক্রেতারা বিব্রত হচ্ছেন। গত দুই বছরে ২১৭টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে আরও ছোট ছোট পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শ্রমিকরা চাকরি হারাবে। মূল্যস্ফীতিও আরও বাড়বে। ফলে আমাদের ওপর তারা বেশি বেতনের চাপ দেবে।’ তার কথায়, ‘অন্যান্য শিল্প কারখানাও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় একই পরিস্থিতির মুখে পড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা দাম বাড়ানোর পরও আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।’
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘এমনিতেই আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আছি। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এটা আরও বাড়বে। ফলে সব কিছুর দাম আরও এক ধাপ বেড়ে যাবে। যার চাপ বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের।’ তিনি বলেন, ‘এর ফলে কৃষি, শিল্পসহ সব উৎপাদন খাতে খরচ বেড়ে যাবে।’ দাম বাড়ানো কতটা যৌক্তিক? এসএস নাজের হোসেন বলেন, ‘সরকার বলছে তারা ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়াচ্ছে। এর সঙ্গে আছে আইএমএফ’র চাপ। কিন্তু আমার বিবেচনায় বিদ্যুৎ খাতে অপচয়, অব্যবস্থাপনা দূর করলে দাম বাড়াতে হতো না। আসলে দুর্নীতি ও পরিকল্পনাহীনতার মূল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।’
সরকার দাবি করছে চলতি অর্থ বছরেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিতে হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকার বলছে, এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৬-১৭ টাকা খরচ হচ্ছে। আর সরকারের পরিকল্পনা হলো বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে দেয়া। কিন্তু বুয়েটের অধ্যাপক এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, ‘আসলে বিদ্যুৎ খাতে এখন কত ভর্তুকি দিতে হয় তা পরিষ্কার নয়। সরকার সেটা প্রকাশও করছে না। সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। গ্যাসে আর ভর্তুকি দিতে হয় না। জ্বালানি তেলে এখন বিপিসি তো লাভ করছে। যদি বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি লাগেই তাহলে সরকার ওই দুই খাতের টাকা সমন্বয় করুক।’ তার কথা, ‘আসলে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রও আমরা পাচ্ছি না। অর্থনীতির কী অবস্থা সে ব্যাপারে কেউ কথা বলছেন না। অর্থনীতির শক্তির ওপর ভর্তুকির সক্ষমতা নির্ভর করে।’
তার মতে, ‘প্রতিবার শতকরা পাঁচ ভাগ বাড়ানো হচ্ছে। তিনবারে ১৫ ভাগ। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে বেশি। কারণ, এটা কিউমিলিটিভ হারে বাড়ানো হচ্ছে। এটা সরকারের একটি কৌশল। কিন্তু সাধারণ মানুষ এর চাপ নিতে পারছে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে গ্যাস আছে তা উত্তোলনের ব্যবস্থা সময় মতো করিনি। এখন তুলতে যে টাকা দরকার, আমাদের তা নেই। আবার কয়লার দাম বেড়েছে। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে সরকার এখন নতুন চুক্তিতে নো ইলেকট্রিসিটি , নো পেমেন্টের কথা বললেও সে রকম কয়টি তা-ও জানা প্রয়োজন। এর সঙ্গে আছে অদক্ষতা। সিস্টেম লসের নামে চুরি আছে। এই সব জায়গা দেখলে আসলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সামসুল আলম বলেন, ‘আসলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে অসম এবং অযৌক্তিক চুক্তি করা হয়েছে। আদানি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। রামপাল এবং পায়রায়ও একই কাজ করা হয়েছে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে দেরি হচ্ছে, তাই আমাদের উল্টো রাশিয়াকে জরিমানা দিতে হচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? আর ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে অর্থ অপচয় তো আছেই।’ তার কথায়, ‘আসলে পরিকল্পিতভাবে এই খাতকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলা হচ্ছে। আমরা শেষ পর্যন্ত বিদ্যুতের আমদানি নির্ভর হয়ে যাই কি-না সেটাই দেখার বিষয়।’