স্টাফ রিপোর্টার: তিন বিভাগীয় শহরের পর রংপুরে বড় সমাবেশ করেছে বিএনপি। গতকাল শনিবার জেলা কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে আয়োজিত বিভাগীয় গণসমাবেশে ঢল নেমেছিল নেতাকর্মীদের। আগের দিন থেকেই বাস বন্ধ করে দেয়া হলেও কিছুতেই থামেনি জনস্রোত। নানা উপায়ে নেতাকর্মীরা শরিক হন সমাবেশে। তাদের কেউ কেউ আগের দিন রাতেই বিভাগীয় শহরের বিভিন্ন স্থানে রাত কাটান। বিশাল সমাবেশে বিএনপি নেতারা সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিন। এখন আর হাতে সময় নেই। অবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। তারা বলেন, বাস বন্ধ করে মানুষের স্রোত আটকানো যায়নি। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন আর কোনো শক্তি জনগণকে আটকাতে পারবে না। মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। দাবি আদায় করেই ঘরে ফিরবে। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। ভোর থেকেই নেতাকর্মীদের পদচারণা ও সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রংপুর নগরী। বিভিন্ন জেলা থেকে আসতে থাকে খ- খ- মিছিল। এসব মিছিল বিভিন্ন সড়ক হয়ে সমাবেশস্থলে পৌঁছায়। সকাল ১০টার মধ্যেই সমাবেশস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। অনেকের মাঠে দাঁড়ানোরও সুযোগ মেলেনি। মাঠে জায়গা না পেয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক ও সড়কের অলিগলিতে অবস্থান নেন নেতাকর্মীরা। সমাবেশস্থলের চারদিকে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। নগরীতে বন্ধ হয়ে যায় রিকশা চলাচল। সড়কের ওপরে হেঁটে চলাচল করতেও হিমশিম খেতে হয়েছে নেতাকর্মীদের। বেলা দুটোয় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও জনসমাগম বেড়ে যাওয়ায় দুপুর ১২টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে গণসমাবেশ শুরু হয়। জেলা নেতাদের বক্তব্যের মধ্যেই দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে সভাস্থলে উপস্থিত হন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রধান অতিথি হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই সরকার সব খেয়ে ফেলেছে। আমাদের যতো অর্জন ছিলো, যত স্বপ্ন ছিলো, সব ধ্বংস করা হয়েছে। এখন যেদিকে তাকাই শুধু চুরি আর চুরি। রাস্তাঘাট, ব্রিজ করতেও চুরি হয়।
এলাকার ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা এমনকী আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নিতেও টাকা দিতে হয়। এই সরকার সব খেয়ে ফেলেছে কিছু বাকি রাখেনি। সরকার সর্বভুক সরকারে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আটকে রেখেছে। খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, দলীয় ৬০০ নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। আলেম-ওলামাদেরও হয়রানি করতে ছাড়েনি। এই সরকারকে আর ক্ষমতায় রাখা যাবে না। বিএনপি মহাসচিব বলেন, এখন কঠিন দুঃসময়। দেশে দুর্ভিক্ষ হলে মানুষ কোথায় যাবে? দেশে দুর্ভিক্ষ হলে সব দায় শেখ হাসিনার।
১৯৭৪ সালেও শেখ হাসিনার বাবার আমলে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। এই সরকার ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াতে চেয়েছিল। এখন চালের কেজি ৯০ টাকা। ডাল, ডিম, চিনিসহ শাক-সবজির দামও আকাশচুম্বী। দেশের মানুষ না খেয়ে আছেন অথচ তারা চিতল মাছ খান। বিদেশে যান। এসি রুমে বসে আরাম আয়েশে থাকেন। আর মুখে শুধু বড় বড় কথা বলেন।
তিনি বলেন, সমগ্র বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক মিডিয়া এই সমাবেশের দিকে তাকিয়ে আছে। সরকার নাকি জনগণকে ভয় পায় না। ভয় না পেলে গাড়ি কেন বন্ধ করতে হয়, কেন আমাদের নেতাদের গুলি করে মারে? নেতাকর্মীরা কষ্ট করে সমাবেশে আসায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে স্থানীয় ভাষায় তিনি বলেন, কেমন আছ বাহে? সরকার নাকি ভয় পায় না, তাহলে ভয় যদি না পাবা, দুই দিন আগে গাড়ি বন্ধ করো কেন? সরকারের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখন আবার নতুন বুলি দিচ্ছে জঙ্গিবাদ। তাদের দমন করবে। ভোঁতা হয়ে গেছে এই অস্ত্র। মার্কিন রিপোর্ট বলেছে, এই সরকার মিথ্যা বলে। মানবাধিকার নিয়ে যে রিপোর্ট দেয়, তা মিথ্যা। নির্বাচনে জোর করে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। মানুষ এখন রুখে দেবে। বন্দুক পিস্তল লাঠি রিভলবার সব ভেঙে চুরমার করে দেবে। একনায়ক হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে মানুষ জেগে উঠেছে। রংপুরের মাটিতে বহু সংগ্রাম হয়েছে। মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আমরা কী মুক্তিযুদ্ধ করেছি হাসিনার এমন বাংলাদেশ দেখার জন্য? আমরা যুদ্ধ করেছি মানুষের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। আমরা যেন ভোট দিতে পারি সে জন্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। আমাদের এমপিরা দল নির্দেশ দিলেই পদত্যাগ করবে।
এই সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে সরকার গঠন করতে হবে। তারপর নির্বাচন। জাতীয় সরকার হবে। যারা আন্দোলন করেছে তাদের নিয়ে সরকার হবে। দেশের অর্থনীতি মেরামত করার জন্য সরকার কাজ করবে। সব শেষ করে দিয়েছে, তা ঠিক করতে হবে। মানুষ আরেকবার বাংলাদেশকে স্বাধীন করবে। ফয়সালা হবে রাজপথে। টেক ব্যাক বাংলাদেশ। যেখানে কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে, গণতন্ত্র থাকবে। স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রংপুর বিভাগকে সালাম! সমাবেশ তিনদিন ধরে চলছে, আজকের না এটা। হাজার হাজার মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রংপুর শহরে এসেছেন। বিরোধীরা সরকারকে প্রতিরোধ করে। এখন শেখ হাসিনা নাকি বিরোধীদের প্রতিরোধ করবেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেশের মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের রাজনীতির নির্ভরশীলতা হচ্ছে পেটোয়া বাহিনী, আওয়ামী পুলিশ লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। কথায় কথায় বাধা দেয়ার কথা বলে, উৎখাতের কথা বলে। যাদের জনগণের সমর্থন আছে, সম্পৃক্ততা আছে তাদের রাজনীতির ভিত্তি হয় জনগণ। বিএনপি’র ভিত্তি হচ্ছে জনগণ। সমাবেশে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, শেখ হাসিনা আপনি বাংলাদেশকে মিথ্যা উন্নয়নের বুলি শুনিয়েছেন। আগে বড়াই করতেন- এত এত রিজার্ভ, এখন রিজার্ভ নেই।
বিশ্বব্যাংক থেকে হিসাব এসেছে, রিজার্ভ নেই। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে টুকু বলেন, এবারের লড়াই জেতার লড়াই। আমরা লড়াই করে বাঁচতে চাই। এই লড়াইয়ে আমরা জয়লাভ করতে চাই। সারা বাংলাদেশ অচল করে দেবো। আপনাদের বাধ্য করবো পদত্যাগ করতে। মানুষের ভাত এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবো। এভাবে নেতাকর্মীদের সমাবেশে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে টুকু বলেন, চিঁড়া-মুড়ি বেঁধে, গামছা বেঁধে আজকের জন্য কর্মীরা অপেক্ষা করেছেন। এটা শেখ হাসিনার জন্য বড় বার্তা। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, যদি জনতা বিক্ষুদ্ধ হয়, বিক্ষোভ করে তাহলে কোনো শক্তি দমিয়ে রাখতে পারে না। আজকে তারা জানান দিচ্ছে, বর্তমান অবৈধ সরকার তোমার সময় শেষ। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ-৩ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য হারুন অর রশিদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াইয়ে নেমেছে। কেউ তাদের থামাতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষের এ জনস্রোত দেখে সরকারের কম্পন ধরে গেছে।
আওয়ামী লীগ বলছে খেলা হবে। তারা বলছে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে নাকি খেলা হবে। আমি বলবো বাংলাদেশের মানুষতো গত ১৫ বছর ধরেই খেলা দেখছে। দিনের ভোট রাতে করে বিনা ভোটে ক্ষমতায় আছেন। বাংলাদেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করছেন। গত দশদিন ধরে আমরা মানুষের কাছে গিয়ে দেখেছি, কেউ এক মুহূর্তের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। মানুষের মৌলিক অধিকার নষ্ট করেছেন। গাইবান্ধার নির্বাচনে চোর-ডাকাতদের চিহ্নিত করেছি। কিন্তু সরকার থেকে এ চোর-ডাকাতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখনো কোনো ডিসি-এসপি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। গণ-সমাবেশে রংপুর মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামুর সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন- বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু, জাহিদুর রহমান জাহিদ এমপি, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল খালেক, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এসএম জিলানী, কৃষক দলের শহীদুল ইসলাম বাবুল, ছাত্রদলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাইফ মাহমুদ জুয়েল, মহিলাদলের হেলেন জেরিন খান প্রমুখ।
সমাবেশস্থলে বিএনপি নেতার মৃত্যু: রংপুরে বিএনপি’র বিভাগীয় গণসমাবেশে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার বিএনপি নেতা মোস্তাফিজুর রহমান অংশ নেন। তবে সমাবেশের শেষ পর্যায়ে সভাস্থলেই তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে সমাবেশে শোক প্রকাশ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। বিএনপি’র নেতারা জানান, শনিবার বিকেল চারটার দিকে রংপুরের কালেক্টরেট ঈদগাহ্ মাঠে মোস্তাফিজুর রহমান মারা যান। তিনি দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র নেতা সুভাষ দাস জানান, মোস্তাফিজুর রহমান কাহারোল থানা বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সমাবেশস্থলে মোস্তাফিজুরের মৃত্যু হয়েছে। আগে থেকেই তিনি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন।