স্টাফ রিপোর্টার: স্থানীয় শিল্পকে আরও কার্যকর করতে দেশীয় বাজার সম্প্রসারণ এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আমরা রপ্তানি যেমন করব, তেমনই নিজের দেশের বাজারও যাতে সৃষ্টি হয় এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। তাহলেই আমাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলো আরও কার্যকর হবে এবং উৎপাদন বাড়াতে পারবে। গতকাল রোববার রাজধানীর পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে মাসব্যাপী ২৭তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ-২০২৩) উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের কূটনীতি শুধু রাজনৈতিক কূটনীতি নয়, এটি হতে হবে অর্থনৈতিক। সেজন্যই প্রতিটি দূতাবাসকে ব্যবসা-বাণিজ্য-রপ্তানি, কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি; আমরা কী রপ্তানি করতে পারি বা কোথা থেকে আমরা বিনিয়োগ আনতে পারি, সেদিকে দৃষ্টি দিতে নির্দেশ দিয়েছি। বিভিন্ন দেশে যখন গিয়েছি, সেখানকার রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এ বিষয়ে ব্রিফ করেছি। যেখানে যে পণ্যের চাহিদা বেশি, সে পণ্যটা আমাদের দেশে আমরা উৎপাদন করে রপ্তানি করব-এভাবেই আমরা বাণিজ্য বৃদ্ধি করব। বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা প্রাপ্তির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই মর্যাদাটা কার্যকর করার জন্য ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন কমিটি করে কোন খাতে আমাদের কী কী করণীয়, সেগুলো সুনির্দিষ্ট করে আমরা এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছি। কোভিডের কারণে আমরা দুই বছর সময় নিয়েছি যে, ২০২৬-এর মধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশ কার্যকর করব, যেটা ২০২৪-এ করার কথা ছিলো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপরই এলো যুদ্ধ-রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, স্যাংশন এবং পালটা স্যাংশন। যে কারণে আজ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। নিজেদের মন্দার দেশ হিসাবে ঘোষণা করছে। আমরা কিন্তু এখনো সেই পর্যায়ে যাইনি। আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক), সিনিয়র বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। স্বাগত বক্তব্য দেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান। অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ ‘আমি তোমাদেরই লোক’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রধানমন্ত্রী পরে মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন। এবারের মেলায় সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, ভারতসহ ১০টি দেশের প্রায় ১৭টি সংস্থা স্থানীয় সংস্থাগুলোর পাশাপাশি অংশ নিচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্য খুব সীমিত। কিছু পণ্যের ওপর আমরা খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এটা বহুমুখী করতে হবে। আমি বারবার এ কথা বলে যাচ্ছি। বহুমুখী করা এবং আমরা যত বেশি বাজার পাব তত বেশি আমরা পণ্য রপ্তানি করতে পারব। আর আমাদের দেশের মানুষের কর্মক্ষমতা যাতে বাড়ে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর বাইরে কলকারখানা না করার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, যারা ইন্ডাস্ট্রি করবেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে করতে হবে। এর বাইরে করলে কোনো ধরনের সেবা পাবেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি। এর মধ্যে অনেকগুলোর কাজ শুরু হয়েছে। এসব অঞ্চলে আমরা ৫জি চালু করব। এটা সব জায়গায় দরকার নেই, এটা অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রযোজ্য। সেভাবে আমরা পরিকল্পনা নিচ্ছি।’ সেবা খাত, বিশেষ করে আইটি ও আইটি এনাবল সার্ভিসের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, গত অর্থবছর এই খাতে রপ্তানি আয় ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎ আর গ্যাস এটা যদি একেবারে নিরবচ্ছিন্ন চান তবে এগুলো ক্রয় করতে বা উৎপাদন করতে যে খরচ হবে, সেই খরচের দামটা তো দিতে হবে। কত আর ভর্তুকি দেয়া যাবে। কারণ ভর্তুকি তো জনগণের পয়সা, এত বেশি দেয়া যায় না। কাজেই ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের এ বিষয়ে অন্তত একটু নজর দিতে হবে। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ায় এখন লোডশেডিং কমে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আজ আপনারা যা যা দেখেন, এত টেলিভিশন, বিমান, হেলিকপ্টার সার্ভিস, ইন্ডাস্ট্রি, ব্যাংক, বিমা, সবার হাতে মোবাইল ফোন-এতকিছু সম্ভব হয়েছে আমাদের সেই বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেয়ার নীতিমালা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ফলে। এমনকি বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেরও উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দুর্নীতি করতে আসিনি, দেশের মানুষের ভাগ্য গড়তে এসেছি। বাবা-মা-পরিবার হারিয়ে এদেশে দুর্নীতি করতে ফিরে আসিনি। সব হারিয়ে দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে এসেছি। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এলে আমাদের সরকারের একটি নীতিমালা ছিলো ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করা, সেটাই করেছি। তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার সরকারে আসার সময় তাদের নির্বাচনি ইশতাহারে ঘোষণা ছিলো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার। আজকে দেশ ডিজিটাল হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘টানা তিন মেয়াদে সরকার প্রবৃদ্ধি ৮-এ তুলে আনতে সক্ষম হলেও কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হয়। তবে ধারাবাহিকভাবে ৬ ভাগের ওপরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি ৭ ভাগ পর্যন্তও তুলতে পেরেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। দারিদ্র্যের হার ৪০ ভাগ থেকে ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছে।’ অনুষ্ঠানে দেশের রপ্তানি কার্যক্রমের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।