বাজারে দামের লাগাম টানতে ৯ পণ্যের দাম বেধে দেয়ার সিদ্ধান্ত
কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দরে পণ্য বিক্রি করলে ব্যবস্থা
স্টাফ রিপোর্টার: বাজারে দামের লাগাম টেনে ধরতে অত্যাবশ্যকীয় ৯টি পণ্যের দর বেধে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পণ্যগুলো হচ্ছে- চাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, মসুর ডাল, ডিম, সিমেন্ট ও রড। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসব পণ্যের যৌক্তিক দাম কী হওয়া উচিত, তা ঠিক করা হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর পর সরকার ঘোষিত দাম মানা না হলে অর্থাৎ কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দরে পণ্য বিক্রি করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
গত মঙ্গলবার বাজারে পণ্যের সরবরাহ, মজুত ও আমদানি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারদর এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এই ৯টি পণ্যের যথার্থ দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে।
বর্তমানে শুধু সয়াবিন, পাম অয়েল ও চিনির দাম বেধে দেয়া হয়। ট্যারিফ কমিশন এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে খুচরা পর্যায়ে কী দাম হওয়া উচিত, সেটার সুপারিশ করে। এদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন জ্বালানি তেল ও এলপিজির দাম নির্ধারণ করে। নির্ধারিত দরে বিক্রি হয় বিদ্যুৎও। এসব পণ্যের সরবরাহকারী সীমিত বলে এটা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তবে ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে পণ্যের দাম বেধে বাজারে স্থিতিশীলতা আনার সুযোগ কম। বাংলাদেশের বাজার কাঠামোও এর সঙ্গে যায় না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এর চেয়ে বাজারে তদারকি বাড়ানো, পদ্ধতিগত উন্নয়ন ও ক্রেতা সচেতনতা বাড়ানোতে জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব পণ্যের সরবরাহকারী সীমিত, সে ক্ষেত্রে মূল্য বেধে দেয়ার সুযোগ আছে। যেখানে বহু ক্রেতা-বিক্রেতা এবং স্তর রয়েছে, সে ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য বেধে দেয়ার সুযোগ নেই। পণ্যমূল্যের সঙ্গে পরিবহন খরচ, অপচয়, সংরক্ষণ ব্যয়সহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত। দেশে আবহাওয়া পরিবর্তন, সড়কের পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। আবার আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই ডলারের দর, জাহাজ ভাড়া ওঠানামা করছে। ফলে দাম বেঁধে দিলে বাজারে অস্থিরতা বাড়তে পারে। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনি ও ভোজ্যতেলের নির্ধারিত দামই এতদিন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এখন অন্য পণ্যের দাম বেধে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য রাখে কিনা, সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
সম্প্রতি দেশের বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ও ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছেন। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সুযোগ নিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। বর্তমানে চাল ও আটার দাম দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে। চিনি ও মসুর ডালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশের বাজারে বেড়েছে। ডিমের দাম নিয়ে দেশে হুলস্থুল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তিন দিনের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনে ৫০ টাকার বেশি বেড়েছিল। নির্মাণ সামগ্রী রড-সিমেন্টের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এ মাসেই বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এক প্রতিবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চিনি ও মসুর ডাল প্যাকেটজাত করে ভোক্তাদের থেকে অযৌক্তিক দাম আদায় করছে। এ দুটো পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার সুপারিশ করে ট্যারিফ কমিশন।
টিপু মুনশি বলেন, এতোদিন ট্যারিফ কমিশন শুধু ভোজ্যতেল ও চিনির দর নির্ধারণ করে দিত। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের দর বাড়ার সুযোগ নিয়ে এই পণ্যগুলোর দাম অতিমাত্রায় বাড়ানো হয়েছে, যা হওয়া উচিত ছিলো না। ব্যবসায়ীদের এই অপতৎপরতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে নজরদারি বাড়ানো হবে। ধারাবাহিকভাবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তাতেও প্রকৃত দামে বিক্রি নিশ্চিত করা যায়নি।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, নির্ধারিত দাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। সরকার নির্ধারিত এই দাম যে কোনো পর্যায়ে অমান্য করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হবে। প্রয়োজনে মামলাও করা হবে। বর্তমানে মজুত, কারসাজি কিংবা কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে বাড়তি দাম রাখার ক্ষেত্রে আইনে সর্বোচ্চ তিন বছর সশ্রম কারাদ-ের বিধান রয়েছে। সরকার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগের ব্যবস্থা করবে।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাজার নিয়ে সরকারের উদ্বেগ আছে এবং একটি স্থিতিশীল মূল্যকাঠামো চাচ্ছে। তবে দর বেধে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশের পণ্য কাঠামো কোনো গ্রেড অনুযায়ী হয় না বা গ্রেডিং করার ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে কোথায় কতোটা মূল্য সংযোজন হচ্ছে, তার হিসাব নেই।
দেশের শীর্ষস্থানীয় রড প্রস্তুতকারক কোম্পানি বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দর বেধে দেয়ার সুযোগ নেই। পণ্যের কাঁচামালের দাম বা উৎপাদনসহ অন্য খরচই বাজার ঠিক করে।
পাইকারি চাল ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, এতে বাজারের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। কারণ প্রত্যেক চালের একাধিক মান আছে। এর বাজারও আলাদা আলাদা। আবার আবহাওয়ার কারণে বাজারে দামের ওঠানামা থাকে। পরিবহন ভাড়া কমবেশি হয়। ফলে এভাবে দাম বেধে দেয়া ঠিক হবে না।
বৈঠকে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মাহফুজা আখতার, এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।