বাজারের চাহিদার চেয়ে মজুত বেশি : এই মুহূর্তে বাজার থেকে তেল উধাও
আগামী দেড় মাসে চাহিদা ২.৭৬ লাখ টন : ৭ ভোজ্যতেল পরিশোধন কোম্পানির তথ্য
স্টাফ রিপোর্টার: রোজাসহ প্রায় দেড় মাসের চাহিদার তুলনায় ভোজ্যতেলের মজুত বেশি আছে। দেশের সাতটি রিফাইনারি মিলের তথ্য পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্রমতে, রোজা শুরু হতে ২০ দিন ও পুরো রমজান মিলে দেশে ২ লাখ ৬৭ হাজার টন তেলের দরকার হবে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মজুত ও সরবরাহ পর্যায়ে আছে ২ লাখ ৭৬ লাখ টন। সেক্ষেত্রে ৯ হাজার টন বেশি আছে। পাশাপাশি আমদানি প্রক্রিয়ায় আছে আরও ২ লাখ ৭২ লাখ টন। এরপরও বাজার থেকে হঠাৎ করেই তেল উধাও হয়ে গেছে। সংকট দেখিয়ে বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দরে।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন-পরিবেশক ও পাইকারের কাছে যে চাহিদা দিচ্ছেন পাচ্ছেন তারও অর্ধেক। পরিবেশক ও পাইকাররা মিল মালিকদের দোষ দিচ্ছে। আর দাম বাড়ানোর কলকাঠি যারা নাড়ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তাদের তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এতে একদিকে ভোক্তার পকেট কাটা যাচ্ছে। অন্যদিকে বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর ভোক্তা প্রতিনিয়ত আস্থা হারাচ্ছেন। এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজার বা বাসা থেকে বেআইনিভাবে তেল মজুতের ঘটনা ধরা পড়ছে। বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে এসব তেল জব্দ করা হচ্ছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরবরাহে ঘাটতি থাকায় এখনও খুচরা বাজারে তেলের জন্য হাহাকার চলছে। সংকট দেখিয়ে বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দরে। প্রতি লিটার ভোজ্যতেল কিনতে ক্রেতা এখনও ১৮০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-দেশে তেলের পর্যাপ্ত মজুত আছে। পাশাপাশি মিল থেকে সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু বাজারে তেলের পরিস্থিতি ¯^াভাবিক হয়নি।
স¤প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দেশের সাতটি রিফাইনারি মিল পর্যায়ে তেলের মজুত পরিস্থিতি জানাতে চিঠি দেয়। চিঠি মোতাবেক মিলগুলো অধিদপ্তরের বিশেষ তদারকি সেলের কাছে তথ্য জমা দেয়। সেই তথ্যে দেখা যায়, দেশের মোট ৭টি মিলে বর্তমানে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের মজুত আছে ১৯ হাজার ৭৩৭ টন। পাশাপাশি অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৯ টন। এই দুই পর্যায়ে মোট ৯৫ হাজার ৬০৬ টন ভোজ্যতেল মজুত আছে। এদিকে সরবরাহ ব্যবস্থায় কমপক্ষে ১০ শতাংশ তেল মজুত থাকে। এ হিসাবে প্রায় ৮০ হাজার টন তেল মজুত রয়েছে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা দোকানে। এসব মিলে সরবরাহ ও মজুত রয়েছ ২ লাখ ৭৬ হাজার টন। পাশাপাশি ওই ৭টি মিল ভোজ্যতেলের এলসি খুলেছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৮০০ টন। যা দেশে আসার জন্য পাইপলাইনে আছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-সাতটি মিলের মধ্যে সিটি গ্রæপের মিলে বর্তমানে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের মজুত আছে ৬ হাজার ৫৮ টন। অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আছে ৩৩ হাজার ৯০২ টন। এলসি খোলার পরিমাণ ৩৬ হাজার টন। এছাড়া মেঘনা গ্রæপের কাছে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের মজুত আছে ৫ হাজার টন। অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আছে ৪৫ হাজার টন। এলসি খোলার পরিমাণ ৩১ হাজার টন। টিকে গ্রæপের কাছে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের মজুত আছে ৪ হাজার ৫০০ টন। অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আছে ৩২ হাজার ৯৫৯ টন। এস আলম গ্রæপের কাছে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের মজুত আছে ২ হাজার ৯১০ টন। অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আছে ৪৯ হাজার ৯০৮ টন। এলসি খোলার পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার টন। পাশাপাশি বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের কাছে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের আছে ১ হাজার ২৩৯ টন। অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আছে ১৪ হাজার ৭০ টন। এলসি খোলার পরিমাণ ৭ হাজার টন। গ্লোবাল এডিবল অয়েলের কাছে ভোজ্যতেলের মজুত আছে ৩০ হাজার টন। অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আছে ৪২ হাজার টন। এলসি খোলার পরিমাণ ৪ হাজার ৮০০ টন। আর সেনা এডিবল অয়েলের কাছে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত ভোজ্যতেল মজুত নেই। শুধু ৩ হাজার টনের এলসি খোলার পরিমাণ উলেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, আলোচ্য ওই ৭ কোম্পানি ছাড়াও আরও কয়েকটি কোম্পানি অপরিশোধিত তেল আমদানি করছে। এর বাইরে পরিশোধিত তেলও আমদানি হচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, আমরা অধিদপ্তরের তদারকি টিমের মাধ্যমে খুচরা থেকে পাইকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দামের তারতম্য ‘ট্র্যাক’ করেছি। মিল পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করে সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে বিক্রি হচ্ছে কিনা তা সরেজমিন গিয়ে দেখেছি। কি পরিমাণ তেল তাদের কাছে আছে তা দেখেছি। এবার আমরা যে ডিলাররা ডিও নিচ্ছে তারা কি দরে বিক্রি করছে সেটা দেখছি। এবং আমরা প্রতিটা রিফাইনারি তাদের গেট পর্যন্ত আমরা যেতে চাই। যাতে ভোজ্যতেল নিয়ে যে কারসাজি হচ্ছে সেটা রোধ করা যাবে। পাশাপাশি কারসাজির সঙ্গে জড়িত একাধিক প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। ৬০ ব্যারেল তেল জব্দসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সিলগালাও করা হয়েছে।
অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মিলে ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুত আছে। আমরা তাদের কাছে তথ্য নিয়েছি। তাদের তথ্য অনুযায়ী তেলে মজুত পর্যাপ্ত। যা দিয়ে রমজানে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। তাছাড়া মিল থেকে চাহিদাপত্র অনুযায়ী তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে মিলে সরবরাহ ¯^াভাবিক আছে। সাধারণ মানুষের কাছে যে তথ্য ছড়ানো হয়েছে মিল সয়াবিন নেই সেটি মিথ্যা। এতদিন পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা বলেছেন মিল থেকে সমস্যা হচ্ছে। তারা সরবরাহ করছে না। কিন্তু মিলে সরবরাহ ¯^াভাবিক আছে। এবার সাপ্লাই চেইনের কোথায় ঘাপলা হচ্ছে, আমরা সেটি বের করার চেষ্টা করছি। অনিয়ম পেলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
সঊত্র জানায়, বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ১২ লাখ টন। এর মধ্যে ৮ লাখ টনই সয়াবিন, সাড়ে তিন লাখ টন সরিষা ও অন্যান্য তেল ৫০ হাজার টন। সরিষা সাড়ে ৩ লাখ টন দেশে উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া আরও কিছু তেল দেশে উৎপাদন হচ্ছে। চাহিদার ৭৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর। সাধারণত প্রতি মাসে ১ লাখ টন তেলের চাহিদা রয়েছে। এ হিসাবে দিনে চাহিদা সাড়ে ৩ হাজার টন। ২০ দিনে প্রয়োজন ৬৬ হাজার ৬৬৬ টন। রোজায় এ চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ফলে রোজার মাসে চাহিদা দাঁড়ায় ২ লাখ টনে। এ হিসাবে রোজার শেষ পর্যন্ত তেলের চাহিদা রয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬ টন। এর বিপরীতে মজুত ও সরবরাহ ব্যবস্থায় রয়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার টন। এ হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকছে ৯ হাজার ৩৩৪ টন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে পরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানির জন্য নতুন এলসি খোলা হয়েছিল ২৮ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে ২৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের এলসি। আলোচ্য সময়ে এলসি খোলা কমেছে ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ২৪ কোটি ৯১ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ১৮ কোটি ১ লাখ ডলারের। আমদানি বেড়েছে ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত অর্থবছরের ওই সময়ে অনিষ্পন্ন এলসি ছিল ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের। এবার তা কমে ৬ কোটি ৭৯ লাখ ডলার হয়েছে। কমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানির জন্য নতুন এলসি খোলা হয়েছিল ৪৫ কোটি ১৫ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে ৮০ কোটি ১০ লাখ ডলারের। আলোচ্য সময়ে এলসি খোলা বেড়েছে ৯৫ দশমিক ০৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৬৮ কোটি ২৭ লাখ ডলারের। আমদানি বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৬০ শতাংশ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অপরিশোধিত তেল আমদানি বেশ বেড়েছে। তবে পরিশোধিত তেল আমদানি কমেছে। অবাক করার বিষয় হলো তেল আমদানির অনিষ্পন্ন এলসি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরের ওই সময়ে অনিষ্পন্ন এলসি ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ ডলারের। এবার তা বেড়ে ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার হয়েছে। বেড়েছে ২ হাজার ২০৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২৭২ কোটি ৫৩ লাখ ডলার বেশি। অর্থাৎ তেল আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টন। গত বছরে ছিল ৯ হাজার ৫৪০ টন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার কারণে স্থানীয় বাজারেই এর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে কোম্পানিগুলো। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সায় না দিলে পরিকল্পিতভাবে বাজারে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট করে এর দাম বাড়াতে থাকে। এদিকে এলসির মাধ্যমে আমদানি করা তেল বন্দরে খালাস না করে সাগরে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে তেল আমদানিতে ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে কোম্পানিগুলো তেল খালাস বাড়াতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।