স্টাফ রিপোর্টার: প্রাথমিক বৃত্তির সংশোধিত ফলেও আস্থা রাখা যাচ্ছে না। পরীক্ষা না দিয়েই এ দফায়ও বৃত্তি পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। হবিগঞ্জ শহরের টাউন মডেল সরকারি বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি পরীক্ষার্থী ইসমাইল হোসেন কোনো পরীক্ষা না দিয়েই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে! তার রোল নম্বর ১০৭২। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোসা. সামছুন্নাহার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এই স্কুলের শিক্ষিকা জিনিয়া আক্তার বলেন, তার মেয়ে খায়রুন জান্নাতও বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তার রোল নম্বর ৭২। ফলাফলে তার নাম এলেও রোল নম্বর প্রদর্শন করা হয় ৭৩। এই রোল নম্বরের ছাত্রী লোপা রানী দাশ। দেখা গেছে, প্রথম দফায় বৃত্তির তালিকায় থাকলেও সংশোধিত ফলাফলে অনেকে বাদ পড়েছে। এর উল্টোটাও ঘটেছে। এতে দ্বিতীয় দফার ফলে শিশুদের কারও মুখে ফুটেছে আনন্দের হাসি। কারণ, এ দফায় তারা বৃত্তি পেয়েছে।
অন্যদিকে, প্রথম প্রকাশিত ফলে বৃত্তি পেয়েও সংশোধিত ফলে বাদ পড়া শিশুদের মন ভার, কেউ কেউ কেঁদেছেও রীতিমতো। অভিভাবকরা তাদের নানাভাবে সান্ত¡না দিয়েছেন। তবে তারা ক্ষুব্ধ। হতাশ এসব শিশুর শিক্ষকরাও। এমনটাই ঘটেছে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার ৪নম্বর ঈশ্বরদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। গেল মঙ্গলবার প্রাথমিক বৃত্তির ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, এ বিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও দারুণ খুশি হন। তাদের মধ্যে একজন ট্যালেন্টপুলে আর বাকিরা সাধারণ কোটায় বৃত্তি পায়। ফল পেয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা মিষ্টি নিয়ে বিদ্যালয়ে হাজির হন। হাসিমুখে শিক্ষকরা মিষ্টি খান, অন্যদের মধ্যেও বিলিয়েছেন। খেতে না পেরে অতিরিক্ত মিষ্টি শিক্ষকদের কেউ কেউ বাসায়ও নিয়ে যান। কিন্তু বাদ সাধে এর কিছু সময় পরই। গণমাধ্যমে সংবাদ আসে- ফল স্থগিত। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিশুদের আনন্দ উচ্ছ্বাস থেমে গেল, চোখে ঘুম নেই। টেনশন ও আতঙ্কে খাওয়া-ধাওয়া বন্ধ প্রায়। পরদিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেন, যারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে এবং বৃত্তি পেয়েছে, তাদের নাম বাদ যাবে না। যারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি, সংশোধিত ফলাফলে কেবল তাদের নাম বাদ যাবে এবং নতুন কিছু যুক্ত হবে। এতে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিশুরা আশায় বুক বাঁধে। তবে রাতে সংশোধিত ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায়, ঈশ্বরদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আগের ফলাফলে পাঁচজন বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর একজনের রোল নম্বরও খুঁজে পাওয়া যায়নি। লজ্জায় পড়েন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা; চরম হতাশ হয়ে ফোন দিয়ে শিক্ষকদের কাছে এমন নজিরবিহীন ঘটনার কারণ জানতে চেয়েছেন।
একই জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সাতজন বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। আগের ফলাফলে ছয়জন বৃত্তি পেয়েছিল। তবে সংশোধিত ফলাফলে তাদের একজনও নেই। এতে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন। আবার কোনো কোনো অভিভাবকের মারমুখী আচরণের শিকার হচ্ছেন শিক্ষকরা। তবে এতে শিক্ষকদের কোনো দায় নেই।
চাকরিজীবী হামিদুল বারী খানের ছেলে সাইফুল্লাহ আল হুযাইফা কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার আড়াইওড়া পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। হামিদুল বলেন, তার ছেলে পরীক্ষা শেষে জানিয়েছিল, পরীক্ষা যথেষ্ট ভালো হয়েছে। তিনি তার বৃত্তি পাওয়া নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলেন। প্রথম প্রকাশিত ফলে সাধারণ গ্রেডের তালিকায় নাম আসে তার। এতে তাঁরা খুশি হন। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, সংশোধিত ফলাফলে তার সন্তানের রোল আসেনি। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘কেন কোমলমতি শিশুদের আবেগ নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে? টানা দুই মাস সময় নিয়ে যে ফলাফলে আমার সন্তান বৃত্তি পেল, কর্তৃপক্ষের পাপমোচনের জন্য একদিনের ব্যবধানে তা কীভাবে মøান হয়ে যায়?’
মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশুতোষ ঘোষ বলেন, পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যারা আগের ফলে বৃত্তি পেয়েছিল, তাদের ফল বহাল রাখা হোক এবং কোমলমতি শিশুদের নিয়ে যারা এমন প্রহসনের খেলা খেলছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক।
গত মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বৃত্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। তবে ভুলত্রুটি থাকায় চার ঘণ্টার মধ্যেই সেই ফল স্থগিত করা হয়। এরপর বুধবার রাতে সংশোধিত ফল প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তবে সংশোধিত তালিকায় সারাদেশে কতজন শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে, তার প্রকৃত সংখ্যা জানাতে পারেননি তারা।
জানা গেছে, সংশোধিত ফলে মূলত যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও ভুলের কারণে বৃত্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তাদের রোল বাদ গেছে। আর যাদের বৃত্তি পাওয়ার কথা নয়, এমন নামও কর্তন করা হয়। পাশাপাশি নতুন করেও অনেকে বৃত্তি পেয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথম দফার ফলাফলে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার সাহরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফসা আক্তার ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। ওই স্কুল থেকে সেসহ মোট চারজন বৃত্তি পায়। তবে সংশোধিত ফলাফলে তাদের কারও রোলই নেই।
হাফসার মা মারুফা আক্তার বলেন, বৃত্তি পেয়েছে শুনে মেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। এখন স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ায় মেয়ে দিশেহারা। সকাল থেকে কান্নাকাটি করছে। কিছু খাচ্ছে না। মেয়ে বলছে, তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। মেয়ের কোনো ক্ষতি হলে দায়ভার কে নেবে? দেখা গেছে, সংশোধিত ফলাফলে সারাদেশেই এ রকম অসংখ্য পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হওয়ায় অনেক বিদ্যালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যায় হেরফের হয়ে গেছে। অবশ্য অনেক জায়গায় আগে যে ফল ছিল, সংশোধিত তালিকাতেও একই ফল আছে।
জানা গেছে, সারাদেশে প্রাথমিক বৃত্তির মোট কোটা ৮২ হাজার ৫০০টি। অবশ্য এবার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে মেধা কোটায় (ট্যালেন্টপুল) বৃত্তি পেয়েছে ৩৩ হাজার ও সাধারণ কোটায় ৪৯ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী। প্রাথমিক বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি মাসে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পায়। এর মধ্যে মেধা কোটায় বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থী মাসে ৩০০ টাকা এবং সাধারণ কোটায় বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা মাসে ২২৫ টাকা করে পাবে। এ ছাড়া বৃত্তি পাওয়া সব শিক্ষার্থী বছরে এককালীন ২২৫ টাকা করে পায়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, ফল তৈরির সঙ্গে যুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কারিগরি দলের ভুলের কারণে মূলত এ ঘটনা ঘটেছে। ফলাফল তৈরির সময় একাধিক উপজেলার কোড একই হওয়ায় সমস্যাটি হয়েছে।