প্রাথমিকে ৪৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগে অদৃশ্য ইশারা
কেন্দ্র হচ্ছে জেলা পর্যায়ে : পরীক্ষা কবে তা জানেন না কেউ
স্টাফ রিপোর্টার: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগে অদৃশ্য হাতের কারসাজি শুরু হয়েছে। এই অদৃশ্য হাতের ইশারায় নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরুতেই কয়েক দফায় ধাক্কা লেগেছে। প্রথমে নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ নিয়ে একটি বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছিলো। দ্বিতীয় ধাপে পরীক্ষার কেন্দ্র নির্ধারণ নিয়েও চলছে নানা নাটকীয়তা। নিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও কোনো একটি মহলের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরীক্ষা ঢাকার পরিবর্তে জেলাপর্যায়ে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সে কারণে প্রথম ঘোষণা অনুযায়ী নিয়োগ পরীক্ষা ১ এপ্রিলের পরিবর্তে ৮ এপ্রিল থেকে শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এ নিয়েও নানা বিতর্ক ওঠায় এখন ৮ তারিখে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়েও চ‚‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। অপর দিকে নিয়োগ কমিটির অধিকাংশ সদস্যের মতামতকে উপেক্ষা করে পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকার পরিবর্তে জেলাপর্যায়ে নেয়ার জন্য চাপ অব্যাহত রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, শুরুতে এবারের নিয়োগ পরীক্ষাটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ করতে মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) এবং জেলাপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারাও নিরলসভাবে কাজ করেছেন। নিয়োগ পরীক্ষা কোনো ধরনের প্রভাব ও ঝুঁকিমুক্ত করতে কয়েকটি ধাপে এই পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় নেয়ার বিষয়েও সবাই একমত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে একটি মহল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে। এই চক্রটি রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে পরীক্ষাটি জেলাপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানাভাবে তদবির ও অব্যাহতভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা কিছু আবেদনকারীকে দিয়ে দু-একটি জেলায় মানববন্ধন করিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা জেলাপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করে।
অন্য দিকে ১৩ লাখেরও বেশি আবেদনকারীর মধ্যে হাতেগোনা কিছু ছাড়া বাকি সব আবেদনকারীই চান নিয়োগ পরীক্ষাটি স্বচ্ছভাবে এবং নিরপেক্ষ ও সব ধরনের চাপমুক্ত থেকেই যেন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রশাসনিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবেও কোন মহল কোনো ধরনের চাপ বা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। সেই লক্ষ্যে দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করা হয়। বলা হয় ৮ এপ্রিল থেকেই এই পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বড় পরিসরে দেনদরবার ও তদবির শুরু হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে এই পরীক্ষা ৮ এপ্রিল থেকেও শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। নতুন করে তারিখ ঘোষণার জন্য শিগগিরই সভা করা হবে বলে জানা গেছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এপ্রিলের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এবং উত্তীর্ণদের জুলাইয়ে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত করা হয়েছিল। তবে ৪৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় হবে, নাকি জেলায় জেলায় নেয়া হবে, তা নিয়ে এখন জটিলতা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে অদৃশ্য একটি ইশারায় সরকারের সব প্রস্তুতি থাকার পরেও আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে।
এই অদৃশ্য ইশারায় ও যোগসাজশে ইতোমধ্যে কিছু জেলায় প্রার্থীদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে বিরোধিতাও করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধন্ত চ‚ড়ান্ত করার পরও এখন বাধ্য হয়েই নতুন করে জেলায় জেলায় পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাবনা তৈরি করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ডিপিইর সূত্র জানায়, শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে হবে, নাকি জেলায় জেলায় হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যদি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা নেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা নেয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে নতুন করে। কোন জেলায় কতটি কেন্দ্রে পরীক্ষা নেয়া হবে, সেসব ব্যবস্থা নেয়ার সম্ভাবনা যাচাই করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর।
এর আগে প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে সচিব জানান, নিয়োগ পরীক্ষা সম্পূর্ণ পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করবে পরীক্ষা নিয়োগ কমিটি। এই কমিটিই সিদ্ধান্ত নেবে পরীক্ষা কোথায় কিভাবে নেয়া হবে।
অন্য দিকে নিয়োগ কমিটির কয়েকজন সদস্যের সাথে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় কথা বলে জানা গেছে, পরীক্ষার তারিখ ও কেন্দ্র বিষয়ে নিয়োগ কমিটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে আগেই সব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। এখন নতুন করে যে জটিলতা তৈরি করা হয়েছে এটা অনাকাক্সিক্ষত। কেননা নিয়োগ কমিটি মনে করছে একটি অদৃশ্য ইশারায় নিয়োগ কমিটির আগের সব সিদ্ধান্ত বাতিল করে নতুন করে সব কিছু সাজানো হচ্ছে। এই অদৃশ্য ইশারায় ইতোমধ্যে পরীক্ষার তারিখ ও কেন্দ্রও পরিবর্তন করতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকের ৩২ হাজার ৫৭৭টি শ‚ন্য পদে নিয়োগের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কিন্তু করোনা মহামারীর বাস্তবতায় নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে অবসরজনিত কারণে আরো ১০ হাজারের বেশি সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য হয়েছে। এতে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ সমস্যা নিরসনকল্পে মন্ত্রণালয় আগের বিজ্ঞপ্তির শূন্যপদ ও বিজ্ঞপ্তির পরের শূন্যপদ মিলিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।