স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণে তার পাশে থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এর সব কৃতিত্ব বাংলাদেশের জনগণের। আমার সবচেয়ে বড় শক্তি জনগণ।’ রোববার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু তৈরি করাটাই একটি ইতিহাস। সেক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী এবং সচিব যারা ছিলেন অর্থ বরাদ্দে এতটুকু কার্পণ্য করেননি বরং কীভাবে আমরা নিজেদের টাকায় করতে পারি, সে জিনিসটি সহজ করে দিয়েছেন।’
অর্থ মন্ত্রণালয়সহ ক্যাবিনেট এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১২ সাল থেকেইতো এই যুদ্ধ শুরু। কত অপবাদ, ষড়যন্ত্র এর জন্য মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর সব থেকে দুঃখজনক যে আরও আগে সেতুর কাজ শুরু করা গেলে আরও আগেই শেষ করা সম্ভব হতো।’ তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় আমার কাছে অবাক লাগে-আমাদের কিছু অর্থনীতিবিদ এবং জ্ঞানী-গুণী বলেছিলেন, এটা ভায়াবল হবে না, কে এখান দিয়ে চলবে, কোনো টাকা উঠবে না। কিন্তু এখন কী দেখা যাচ্ছে?’
সেতু নির্মাণ হওয়ায় মানুষের জীবন-জীবিকার আমূল পরিবর্তন ঘটবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু তৈরির আগে প্রতিবছরই উত্তরবঙ্গে মঙ্গা দেখা দিত। অথচ সেতু নির্মাণের পর সেখানের মঙ্গা নেই। এখন পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সাপ্লাই চেইন স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইলিশের মৌসুম এসে যাওয়ায় রাজধানীতে বসেই তাজা ইলিশপ্রাপ্তিও সম্ভব হবে, অন্যদিকে জেলেরাও লাভবান হবে। পদ্মা সেতু দেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের বিরাট মাইলফলক।’
সেতু নির্মাণের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য ছিল না এবং এরপরই ঘোষণা দিলাম নিজের টাকাতেই পদ্মা সেতু করব, অন্যের টাকা নেব না।’
আ.লীগ নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে চায় : এদিন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোর ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছি, সেটা বাস্তবায়ন করতে চাই। চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দেশকে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের মূল অয়োজনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতাহার অনুযায়ী আমরা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছি। পাশাপাশি জাতির পিতার চালু করে যাওয়া গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের অনুসরণে দেশের সব গৃহহীনকে ‘মুজিববর্ষে’ বিনামূল্যে একটি ঘর করে দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছি।
অনুষ্ঠানে বার্ষিক কর্মসম্পাদনে সাফল্য অর্জনকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলো এবং ব্যক্তিবিশেষের মাঝে ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন পুরস্কার ২০২২’ ও ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার ২০২২’ প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এ সময় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ বার্ষিক কর্মসম্পাদনে শীর্ষস্থান অর্জন করে। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কৃষি মন্ত্রণালয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। এর আগে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং সিনিয়র সচিবরা নিজ নিজ দপ্তরের পক্ষে চলতি বছরের জন্য বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। অনুষ্ঠানে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির ওপর একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
উল্লেখ্য, ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ব্যক্তিগত বিভাগে সাবেক খাদ্যসচিব ড. মোসাম্মাৎ নাজমুনারা খানম এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (অবকাঠামো ও উন্নয়ন) মো. মামুন আল রশিদ সততা অনুশীলনে তাদের অসামান্য ভূমিকার জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন। শুদ্ধাচার প্রয়োগে খাদ্য মন্ত্রণালয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০০৯ সাল থেকে জনগণের সমর্থনে টানা ক্ষমতায় থাকার সুবাদে দেশকে কিছুটা হলেও এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। জনগণের জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন বলেই সরকার দেশকে এই অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছে।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বার্ষিক কর্মসম্পাদনে শীর্ষস্থান অর্জন করায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগসহ পুরস্কারপ্রাপ্ত ১০টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়েও যারা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের অভিনন্দন জানান।
করোনা মোকাবিলার সরকারের সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উন্নত দেশও যেটা পারেনি, সেটা আমরা করেছি। বিনা পয়সায় টার্গেটেড জনগণকে টিকা দিয়েছি। এখন বুস্টার ডোজও দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যেই দেশে বন্যার আগমন ঘটেছে, যা সরকার যথাযথভাবে মোকাবিলা করছে। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা-এই সবকিছুর মাঝেই সরকার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মধ্যেও পদ্মার বুকে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে সরকারের সাফল্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ সামরিক শাসন আমাদের এমনভাবে পরনির্ভর করে ফেলেছিল যে, আমাদের নিজস্ব চিন্তাচেতনা এবং স্বকীয়তার কথা মানুষ যেন ভুলতে বসেছিল। আর মানুষ যখন তার আত্মবিশ্বাস হারায়, তখন সেই জাতিকে টেনে তোলা খুব কষ্টকর। কিন্তু জাতির পিতা বাংলার মানুষকে চিনতেন বলেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার কন্যা হিসাবে মানুষের পাশে থাকার সুযোগে যতটুকু তাদের চিনতে পেরেছিলেন, সেই ভরসাতেই বলেছিলাম, নিজস্ব অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করব। আর এই একটি সিদ্ধান্তই বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু শুধু ইট, কাঠ, কংক্রিটের একটি স্থাপনা নয়; এটি আমাদের আত্মমর্যাদার নিদর্শন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানীতে পণ্য আসার পরিমাণ অনেকাংশে বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে পাইকারি বাজার ও কাঁচাবাজার হিসাবে কাওরান বাজারের ওপর চাপ কমিয়ে রাজধানীর বাইরের অংশে আমিনবাজার, কাঁচপুর, মহাখালী, পোস্তগোলা বা কেরানীগঞ্জসহ চারটি স্থানে চারটি বাজার সম্প্রসারণের পরামর্শ দেন তিনি।