দর্শনা কেরুজ ডিস্টিলারিতে ঠিকাদারের মাধ্যমে চিটাগুড় পরিবহন প্রথা বাতিল
নজরুল ইসলাম: যোগাযোগ এবং কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে এলাকাভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে কর্মসংস্থান যেনম সৃষ্টি হয় তেমনই ওই এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটে। সইে সাথে প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের একটি লাভ লোকশানের হিসাব অর্থবছর শেষে কষতে হয় কর্তৃপক্ষকে। তেমনই দর্শনা কেরুজ চিনিকল সার্বিক অর্থে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও কিছু কিছু জায়গায় অতীতের নিয়ম কানুন চালু থাকায় লোকশান গুনতে হয়। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকশানের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ডিস্টিলারীর অ্যালকোহল (মদ) উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল চিটাগুড় (মোলাসেস)। বিভিন্ন চিনিকল থেকে ডিস্টিলারীর ১৪ হাজার মে. টন চিটাগুড় ঠিকাদারের মাধ্যমে পরিবহণ করে আনতে বছরে খরচ হয় প্রায় ১ কোটি টাকা। সেই পরিবহণ ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যায় সাশ্রয় হয়েছে কর্তৃপক্ষের। পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক কার্যক্রমও শুরু হয়ে গেছে। বর্তমানে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১ টন চিটাগুড় কিনছে ২২ হাজার টাকা দিয়ে। তবে এ দাম সবসময় একই রকম থাকে না। কম বেশি হয়ে থাকে। আর এর দাম নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেন।
ব্রিটিশ শাসন আমলে মূলত এ্যালকোহল তৈরীর লক্ষ্যেই ১৯৩৮ সনে প্রাথমিকভাবে ১৮ হাজার প্রুফ লিটার স্পিরিট তৈরীর লক্ষ্যে তদানিন্তন নদীয়া জেলার অন্তর্গত দর্শনায় স্থাপিত হয় চিনিশিল্প, ডিস্টিলারি ও বাণিজ্যিক খামারের সমন্বয়ে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (বাংলাদেশ) লিঃ নামের শিল্প কমপ্লেক্স। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সুগার এ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এখানে রেকটিফাইড স্পিরিট, দেশী ও বিলেতী এ্যালকোহল, (জিন, হুইস্কি, রাম, ব্রান্ড, ভদকা) ভিনেগার এ শিল্প প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত মূল পণ্য। আর এসব উৎপাদিত এ্যালকোহল তৈরীর মূল উপাদান চিটাগুড় (মোলাসেস)। ডিস্টিলারীতে প্রতিবছর চিটাগুড় লাগে ১৮ হাজার মে.টন। নিজেস্ব চিনিকলে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার মে.টন চিটাগুড় উৎপাদিত হলে বাকি ১৪ হাজার মে.টন চিটাগুড় দেশের বিভিন্ন চিনিকল থেকে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ নগদ অর্থে ক্রয় করে থাকে। এর মধ্যে ফরিদপুর থেকে ১৫শ মে.টন, কুষ্টিয়া থেকে ২ হাজার মে.টন, পাবনা থেকে ১ হাজার মে.টন, নর্থবেঙ্গল থেকে ৩ হাজার ৫শ মে.টন, নাটোর থেকে ১৫শ মে.টন, রাজশাহী থেকে ১ হাজার মে.টন, রংপুর থেকে ১ হাজার মে.টন, পঞ্চগড় থেকে ৫শ মে.টন এবং মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস থেকে ২ হাজার মে.টন। আর ক্রয়কৃত চিটাগুড় এতদিন ট্যাংকলরী পরিবহণ ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়ে আসতো। বর্তমান চিনিকলের ব্যবস্থা পরিচালক বিষয়টি আমলে নিয়ে নিজেস্ব পরিবহণে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে অবহিত করেন। করপোরেশন সহযোগিতায় দীর্ঘদিনের ঠিকাদারী প্রথা বাতিল করে দেন। চিনিকল সূত্রে জানাগেছে, ঠিকাদারের মাধ্যেমে চিটাগুড় আমদানিতে কর্তৃপক্ষের খরচ হয় ৯৬ লাখ ৭৮ হাজার ৫শ টাকা। নিজেস্ব পরিবহণে আনার ফলে খরচ হচ্ছে ৫১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৫৫ টাকা। এ ক্ষেত্রে চিনিকল কর্তৃপক্ষের সাশ্রয় হচ্ছে ৪৪ লাখ ৯২ হাজার ৫৪৫ টাকা। চিটাগুড় আমদানিতে পরিবহণ খাতে খরচের হিসেবে দেখা গেছে, ফরিদপুরে ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, কুষ্টিয়ায় ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, পাবনায় ৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, নর্থবেঙ্গলে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৫শ টাকা, নাটোরে ১১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, রাজশাহীতে ৯ লাখ ২১ হাজার টাকা, রংপুরে ১৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, পঞ্চগড়ে ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। মোবারকগঞ্জ চিনিকলের খরচের হিসাব চিনিকলের নিজেস্ব খাতের খরচ। বর্তমানে চিনিকল কর্তৃপক্ষ এক মে.টন চিটাগুড় পরিবহণ খরচ বাদে ক্রয় করছে ২২ হাজার টাকায়। নিজেস্ব ত্বতাবধায়নে পরিবহণের মাধ্যমে চিটাগুড় আনায় চিটাগুড়েরর গুণগত মান যেমন ঠিক থাকছে তেমনই সময়মতো মালামাল ডিস্টিলারীতে পৌঁছেছে। ঠিকাদারের মাধ্যমে চিটাগুড় আনলে অনেক সময় ভেজাল হতো।
এদিকে ডিস্টিলারিতে উৎপাদিত দেশব্যাপী দেশী এ্যালকোহল বিক্রয় কেন্দ্র ১৩টি ও ফরেন লিকার বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে (দর্শনা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম) ৩টি। প্রতিবছর ডিস্টিলারিতে দেশী এ্যালকোহল তৈরী হয় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ প্রুফ লিটার। প্রতি প্রুফ লিটার এ্যালকোহলের মূল্য প্রায় ২২০ টাকা। বছরে দেশী এ্যালকোহল বিক্রি হয়ে থাকে প্রায় ৭৩ কোটি টাকার মতো। অপরদিকে প্রতি বছর ডিস্টিলারিতে বিলেতী এ্যালকোহল তৈরী হয় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কেস। প্রতি কেস ১১ হাজার টাকা মূল্য হিসেবে বিক্রি মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১শ ৫০ কোটি টাকা। প্রতিবছর চিনিকল কর্তৃপক্ষ দেশী ও বিলেতি এ্যলকোহল বিক্রি করে থাকে প্রায় ২শ কোটি টাকার ওপরে। আর সরকার এসমস্থ এ্যালকোহলের ওপর থেকে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় করে থাকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা। প্রতি বছর বিলেতী এ্যলকোহল বিক্রির জন্য প্রতিষ্ঠনটির বোতল লাগে ৩০ লাখ পিস। বিগত দিনে প্রতিটি বোতল ক্রয় করতে হতো ২৭ টাকা দরে। পাশাপাশি কাঁচামাল, প্রক্রিয়াজাত, প্যাকিংদ্রব্য সামগ্রী, বেতন ও মজুরি, স্টাফ কল্যাণ ফা-, মেরামত ও রক্ষাণাবেক্ষণ, বৈদ্যুতিক দ্রব্যাদি ও জ¦ালানী, বীমা ঋণের সুদ, প্রশাসনিক ওভারহেড, অবচয়, বিক্রয় ওভারহেড ব্যয় বাবদ প্রায় খরচ দেখানো হয়েছে ৭৯ কোটি ৬৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। চলতি মরসুমে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অতিরিক্ত সচিব ও চেয়ারম্যান তদারকি করে সেই বোতল ক্রয় করেছে সাড়ে ১৯ টাকা দরে। বোতল প্রতি সাশ্রয় হয়েছে ৮ টাকা। সে হিসেবে বছরে শুধুমাত্র বোতল বাবদ প্রায় আড়াই কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এবার পরিবহণ সেক্টরে সাশ্রয় হলো প্রায় অর্ধকোটি টাকা।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা বলেন, অতীতে কি হয়ে সে বিষয়টি আমার বিবেচ্য না। অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে যা করনীয় তাই করা হবে। এর জন্য কোনোপ্রকার দুর্নীতি অনিয়ম সহ্য করা হবে না। ব্যক্তি স্বার্থে নয় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সকলকে সততার সাথে কাজ করতে হবে। এতে সরকারের পাশাপাশি লাভবান হবে শিল্প অঞ্চলের মানুষ।
চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, পরিকল্পনা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব। এ প্রতিষ্ঠানের সাথে জিড়িয়ে আছে এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা। সেই সাথে এলাকার আর্থ সামাজিক উন্নয়নে চিনিকলটি ভূমিকা রেখে চলেছে। সততা এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে একদিন এ প্রতিষ্ঠনটি আরও উন্নতি করবে বলে আমি বিশ^াস করি। আমি অনৈতিকভাবে কিছু অর্জন করতে আসেনি। প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সর্বমহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।