ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার শেষ দিনে চরম ভোগান্তি
স্টাফ রিপোর্টার: ঈদের পর কর্মস্থলে ফেরার শেষ দিনে দুই ফেরিঘাটে চরম ভোগান্তিতে পড়েন দক্ষিণ-পঞ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। উত্তরবঙ্গের যাত্রীরা টাঙ্গাইল ও ঢাকার প্রবেশমুখে আটকা পড়েন। দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা লঞ্চে গাদাগাদি করে ফেরেন গন্তব্যে। অনেকেই আসন না পেয়ে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে ও ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চের ছাদে এসেছেন। এছাড়া পথে পথে বাড়তি ভাড়াও গুনতে হয়েছে যাত্রীদের। পদ্মা পাড়ি দিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয়েছে। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, রোববার সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস ও শিল্প-কারখানা খোলা। এ কারণে শনিবার শেষ দিনে বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। সড়ক-মহাসড়কে গণপরিবহণ ছাড়াও ব্যক্তিগত ও মোটরসাইকেলের চাপ ছিল। এতে মানুষের ভোগান্তিও হয়েছে।
গতকাল শনিবার দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া এবং বাংলাবাজার-শিমুলিয়া-এ দুই ফেরিঘাটে দিনভর হাজার হাজার গাড়ির দীর্ঘ সিরিয়াল ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরও মেলেনি ফেরি। গাড়ির চাপে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ১২-১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। ফেরি পার হতে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে। শুক্রবার রাতে যেসব গাড়ি দৌলতদিয়া ঘাট এসেছে সেগুলো শনিবার সারা দিন অপেক্ষার পর বিকালে পদ্মা পাড়ি দিয়েছে। অপরদিকে বাংলাবাজার ফেরিঘাটে পার্কিং ইয়ার্ডে দিনভর চারশ থেকে পাঁচশ গাড়ি পারাপারের জন্য অপেক্ষায় ছিল। তবে ‘ভিআইপি’ নামে বিশেষ গাড়ি পারাপারের সুযোগ দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। এ ঘাটে মোটরসাইকেলের হুড়োহুড়িতে আতঙ্কজনক পরিস্থিতির তৈরি হয়। ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি আটকে থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরা। পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকা, তীব্র গরম ও বৃষ্টিতে নাকাল হয়েছেন ঢাকামুখী যাত্রীরা। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের কষ্ট ছিল অবর্ণনীয়।
দুই ফেরিঘাট ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় বাস, লঞ্চ ও ট্রেনের টিকিট সংকটে পড়েন ঢাকামুখী যাত্রীরা। বাসে জনপ্রতি ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া গুনে গন্তব্যে পৌঁছান যাত্রীরা। এছাড়া বৃষ্টির কারণে মহাসড়কগুলোতে গাড়ির গতি বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে ঢাকায় আসার পথে টাঙ্গাইলে কয়েক কিলোমিটার থেমে থেমে গাড়ি চলে। ঢাকায় প্রবেশপথ আশুলিয়ায় যানজটে কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়েছে যাত্রীদের। এছাড়া ভোগান্তি ছিল নৌপথের যাত্রীদেরও। বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় যাত্রী চাপ বেশি থাকায় লঞ্চে উঠতেই হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের। ধাক্কাধাক্কি করে লঞ্চে উঠতে পারলেও বসার জায়গা না পেয়ে সারা পথ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এছাড়া ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চের ছাদে চড়েও গন্তব্যে গেছেন অনেক মানুষ।
সাতক্ষীরা থেকে কে লাইন পরিবহণের বাসে ঢাকায় ফিরেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাইদুর রহমান। শনিবার রাতে তিনি জানান, শুক্রবার রাত ৯টায় তার গাড়ি ঢাকার উদ্দেশে সাতক্ষীরা থেকে রওয়ানা হয়ে রাত ২টার দিকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে পৌঁছে। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ফেরিতে ওঠে তাকে বহনকারী গাড়ি। তিনি বলেন, আমার সারা জীবনে এমন কষ্ট পাইনি। সারা রাত ও দিন বাচ্চাসহ গাড়িতে বসে কাটিয়েছি। তীব্র গরমে সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ফেরিঘাটে পর্যাপ্ত টয়লেটেরও ব্যবস্থা নেই। এতে মহিলা ও বয়স্ক মানুষ বেশি বিপদে পড়েন। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আরও কয়েকজন যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিক।
দুই ফেরিঘাটে গাড়ির দীর্ঘজটে মানুষের ভোগান্তির জন্য যাত্রী ও মোটরসাইকেলের চাপকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ করপোরেশনের চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী। শনিবার রাতে তিনি বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় ২১টি এবং শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মাঝিরকান্দি রুটে ১০টিসহ সারা দেশে মোট ৪৯টি ফেরি চলাচল করছে। তবুও গাড়ি পার হতে দীর্ঘ সময় লাগছে। এর কারণ হচ্ছে, ঘাটে ফেরি আসলেই প্রচুর সংখ্যক যাত্রী ফেরিতে উঠে পড়ছেন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে-মানুষের মতো প্রচুর সংখ্যক মোটরসাইকেলও ফেরিতে উঠছে। এ দুটি কারণে ফেরিতে গাড়ি উঠানো যাচ্ছে না। ফেরির ট্রিপ কার্যকর হচ্ছে না। তিনি জানান, শুক্রবার সারা রাতই ফেরিতে মোটরসাইকেল পার করা হয়েছে। এ কারণে বাসের সিরিয়াল দীর্ঘ হয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া এবং আরিচা-কাজিরহাট রুটে ২১টি ফেরিতে ১৩ হাজার ৭৮৩টি গাড়ি পার করা হয়। এর মধ্যে তিন হাজার ৩০৮টি মোটরসাইকেল। অপরদিকে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া এবং মাঝিরকান্দি-শিমুলিয়া রুটে ১০টি ফেরিতে ৫ হাজার ১০২টি গাড়ি পার করা হয়, এর মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল ২ হাজার ৬৭৭টি। আরও সহস্রাধিক গাড়ি ঘাটে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় আছে।
ফেরিঘাটে ভোগান্তি: গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি শামীম শেখ জানান, মানুষ ও যানবাহনের চাপে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সারা রাত, শনিবার সারা দিন দৌলতদিয়া ঘাটের তীব্র যানজট ছিল। শনিবার দিনভর যানবাহনের এ সিরিয়াল দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের খানখানাপুর ছোট ব্রিজ পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া গোয়ালন্দ মোড় থেকে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কে আরও ৩ কিলোমিটারের মতো যানবাহনের দীর্ঘ লাইন ছিল। সবমিলিয়ে ১২-১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে থাকার পর শত শত যাত্রীকে হেঁটে লঞ্চ-ফেরি ঘাটের দিকে রওয়ানা দিতে দেখা যায়। এ সময় তাদের কাঁধে ও মাথায় ছিল শিশু বাচ্চা, ব্যাগ ও বিভিন্ন জিনিসপত্র।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাস থেকে নেমে হেঁটে ঘাটের দিকে রওয়ানা হন খুলনা থেকে আসা শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাসের মধ্যে ৬ ঘণ্টা ধরে বসে আছি। সঙ্গে পরিবার ও ব্যাগ থাকায় বাস থেকে নেমে যেতে বাধ্য হচ্ছি। তীব্র গরমে অনেক কষ্ট হচ্ছে। দুর্ভোগ কাকে বলে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। মাগুরা থেকে বাসে আসা নাজমুল হোসাইন (৩২)। স্ত্রী ও ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে তিনি বলেন, সকালে ঢাকার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হই। রাস্তায় দূরপাল্লার কোনো বাসে সিট পাইনি। লোকাল বাস, অটোরিকশা ও রিকশায় ঘাট থেকে প্রায় ১১-১২ কিলোমিটারে দূরে যানজটে আটকে পড়ি। প্রায় দুই ঘণ্টা লোকাল বাসে বসে থাকার পর একপর্যায়ে স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করি। ভেঙে ভেঙে আসতে তার অন্তত তিনগুণ বাড়তি টাকা খরচ হয়েছে বলে তিনি জানান। দুপুর ২টার দিকে আলাপ হয় সাতক্ষীরা এক্সপ্রেসের যাত্রী রাবেয়া সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেন, দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় মহাসড়কে প্রায় ১০ ঘণ্টা আটকে রয়েছেন। অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বাসের ভাড়াও বেশি আদায় করা হয়েছে। সাধারণ সময়ে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা যেতে ৫০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। কিন্তু এখন নেওয়া হয়েছে ৮০০ টাকা। এদিকে দৌলতদিয়ায় দীর্ঘ সিরিয়াল থাকায় রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার এমএম শাকিলুজ্জামান দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটের বিকল্প পথ যমুনা সেতু দিয়ে চলাচল করতে জরুরি পণ্যবাহী ও কাঁচামালবাহী ট্রাক ও কাভার্ড চালকদের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, মহাসড়কে কর্মমুখী মানুষ ও যানবাহনের অত্যাধিক চাপ। এ অবস্থার মধ্যে অধিকাংশ চালক সড়কের শৃঙ্খলা মেনে চলেন না। সবাই আগে যেতে চান। ফলে মাঝেমধ্যেই মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ঘাটের ওপর চাপ কমাতে ও দীর্ঘ সময় আটকে না থেকে জরুরি পণ্যবাহী গাড়িগুলোকে লালন শাহ সেতু ও বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু দিয়ে চলাচল করতে পরামর্শ দিচ্ছি।
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শিহাব উদ্দিন জানান, বর্তমানে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ছোট-বড় ২১টি ফেরি চলাচল করছে। চালু রয়েছে ৪টি ফেরি ঘাট। ৩টি ঘাট বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, শুক্রবার এ রুটের দুটি ফেরি বিকল থাকাতে সমস্যা প্রকট হয়। শনিবার ভোর থেকেই মহাসড়ক যানবাহন ও যাত্রীদের ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ যাত্রী ও ব্যাক্তিগত শত শত গাড়ি ঘাটে এসে ভিড় করছে। কোনো ফেরি ঘাটে ভেড়া মাত্রই তারা হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ছেন। ফলে ফেরিতে পর্যাপ্ত বাস ও অন্যান্য যানবাহন পারাপার করা যাচ্ছে না। এতে করে মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসের সারি দীর্ঘ হচ্ছে।