স্টাফ রিপোর্টার: দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমে ফের জটিলতা দেখা দিয়েছে। মডার্নার টিকা দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার মহানগরগুলোতে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে আগ্রহীদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রথম ডোজ দেয়ার মতো অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজারের টিকাও নেই। এদিকে গত ৭ থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত গণটিকা কার্যক্রম ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ। মজুত নিশ্চিত না করেই সবাইকে টিকা নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। ফলে যারা ক্যাম্পে গেছেন তাদের অধিকাংশই টিকা ছাড়াই ফিরে এসেছেন। যে কোনোভাবে প্রথম ডোজ যারা পেয়েছেন তারা কবে নাগাদ দ্বিতীয় ডোজ পাবেন এ সংক্রান্ত কোনো রোডম্যাপ এখনো চূড়ান্ত নয়। এছাড়া যেসব নাগরিক এখন পর্যন্ত কোনো ডোজই পাননি তারা কবে নাগাদ পাবেন তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে গণটিকায় ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা এবং সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এ অবস্থার মধ্যেও টিকাপ্রাপ্তিতে রাজনৈতিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ ছিল লক্ষ্য করার মতো। বেশির ভাগ কেন্দ্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকা ছাড়াই বাড়ি ফিরেছেন নারী-পুরুষ। পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিল না থাকায় বিশৃঙ্খলার মধ্যেই গতকাল শেষ হয় গণটিকা ক্যাম্পেইন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দায়িত্বপ্রাপ্তদের উদাসীনতা ক্যাম্পেইন শুরুর আগে থেকেই লক্ষ করা গেছে। তিন দিনে ক্যাম্পেইনে কত টিকা দেয়া হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তিন ধরনের মন্তব্য করতে দেখা গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কোনোটিই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কাজ শুরুর আগে সঠিক পরিকল্পনা করলে এবং ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন, সম্প্রতি পরিচালিত গণটিকা ক্যাম্পেইনে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। একটি কমিটি গঠন করে এসবের তদন্ত করা উচিত। কারণ এখানে পরিকল্পনায় গলদ না অন্য কোনো কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা প্রকাশ হওয়া উচিত। অন্যথায় দিনে দিনে এ ধরনের জটিলতা বাড়তেই থাকবে। তিনি বলেন, প্রথমবার ভারত থেকে সময়মতো না আসায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তারপর বলা হয়েছিল, ফাইজার ও মডার্নার টিকার দ্বিতীয় ডোজ সংরক্ষণ করেই প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু সেখানেও দেখা দিয়েছে জটিলতা। কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয় ডোজ প্রত্যাশীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে টিকা নেই বলে। অথচ এই দুই টিকা চার সপ্তাহ বা এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার নিয়ম রয়েছে।
জানা গেছে, দেশে এখন চার কোম্পানির কোভিড-১৯ টিকা দেয়া হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও সিনোফার্মের টিকা। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে এসব কোম্পানির মোট দুই কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার ৯২০ ডোজ টিকা এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক কোটি ১৯ লাখ ৪৩ হাজার ৩০০, মডার্নার ৫৫ লাখ, সিনোফার্মের ১ কোটি ১৫ লাখ ডোজ এবং ফাইজারের এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা। মঙ্গলবার পর্যন্ত (১০ আগস্ট) এক কোটি ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ৬২০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। আর মজুত আছে ৫৯ লাখ ৭২ হাজার ৩০০ ডোজ। এরই মধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়ার মতো অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্নার টিকা আর নেই। অন্যদিকে দেশে সিনোফার্মের ৯৮ লাখ ডোজের মধ্য থেকে ৬৮ লাখ প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন আরও দুই লাখের বেশি মানুষ।
তবে রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেছেন, প্রথম ডোজ নেওয়ার দুই মাস পর টিকা নিলেই কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, প্রথম ডোজ গ্রহণের ফলে প্রাথমিক অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। পরে দ্বিতীয় ডোজ নিলে অধিকতর শক্তিশালী অ্যান্টিবডি পাওয়া যাবে। এ নিয়ে চিন্তিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এদিকে নিবন্ধনের কিছু শর্ত শিথিল এবং গণটিকাদান শুরু হওয়ায় মানুষের মাঝে কিছুটা স্বস্তি দেখা দিয়েছিলো। তারা উৎসাহ নিয়ে দল বেঁধে টিকাকেন্দ্রে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু দুই থেকে সাড়ে তিনশ মানুষকে দেয়ার বলা হয়েছে, টিকা শেষ। ছয় দিন ধরে এ অবস্থাই চলেছে প্রায় সারা দেশে। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে খবর মিলছে, চাহিদার তুলনায় মানুষের ভিড় বেশি। তাই অনেককেই ফিরতে হয়েছে টিকা না নিয়ে। কেউ কেউ দু-তিন দিন ঘুরেও টিকা নিতে পারেননি। বৃহস্পতিবার গণটিকাদান কর্মসূচির শেষ দিনেও রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। টিকা পেতে কোনো কোনো কেন্দ্রে আগের রাত থেকেই লাইন ধরছেন মানুষজন। গাদাগাদি, হুড়োহুড়িও চলছে। মারামারি হয়েছে, কেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু বিপুল চাহিদার তুলনায় টিকা কম থাকায় শেষ পর্যন্ত অনেককেই খালি হাতে আসতে হয়েছে।
শুরুতে ৭ আগস্ট থেকে এক সপ্তাহে কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে পরে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত না থাকায় মাত্র ৩২ লাখ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গত শনিবার থেকে গণটিকাদান শুরু হয়। এই কর্মসূচির পর ১৪ আগস্ট থেকে আবার গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আবার এই কর্মসূচি চলবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। টিকার পর্যাপ্ততার ওপর পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে। এমন পরিস্থিতিতে টিকা কার্যক্রমের সম্পৃক্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই কর্মকর্তা টিকা ডেপ্লায়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক এবং উপপরিচালক ডা. মাওলা বক্স দুজনেই কোভিড আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জনগণের প্রত্যাশা থাকলেও গণটিকাদান কর্মসূচি আবার শুরু করা হবে কিনা তা নির্ভর করছে টিকার পর্যাপ্ততার ওপর। অধিদপ্তরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন বলেন, আসলে আমরা আবার ক্যাম্পেইন করতে পারব কিনা তা নির্ভর করছে টিকার অ্যাভেইলিবিলিটির ওপর। পর্যাপ্ত টিকা থাকলে হয়তো আবার ক্যাম্পেইন হবে।
গত ৭ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী গণটিকা দেয়া শুরু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ৭ আগস্ট টিকা দেয়া হয়েছে ৩১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬ জন, ৮ আগস্ট টিকা দেয়া হয়েছে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৪৮ ডোজ, সোমবার দেয়া হয়েছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৮২ ডোজ, মঙ্গলবার দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৫৮ ডোজ এবং বুধবার দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৮৭ ডোজ। এই পাঁচ দিনে ৫৪ লাখ ৭ হাজার ৩৪১ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। বুধবার অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ পেয়েছে ১০৭ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ১১ হাজার ৭৫১ জন। এখন পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৭০ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪৭ লাখ ৭০ হাজার ৭৪৮ জন। বুধবার ফাইজারের প্রথম ডোজের টিকা কাউকে দেওয়া হয়নি এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪ হাজার ৮৮৯ জন। এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৮২ হাজার ৭৩৪ ডোজ। এছাড়া চীনের সিনোফার্মের টিকা এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ৭১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭২ ডোজ। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে ৬৯ লাখ ৪০ হাজার ৯৪৮ জনকে আর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৯২৪ জনকে। মডার্নার টিকা এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ২২ লাখ ২০ হাজার ৫৮৩ ডোজ। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে ২২ লাখ ১১ হাজার ৭৮৯ জনকে এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে ৮ হাজার ৭৯৪ জনকে।
মহামারিতে আক্রান্ত ও মৃত্যু ঠেকাতে দেশের ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ কোটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। টাস্কফোর্স বলছে, বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ নাগরিককে টিকা দিতে ১৩ কোটি ১৮ লাখ ডোজ লাগবে। আর ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে লাগবে প্রায় ২০ কোটি ডোজ। বাংলাদেশ এখন যে হারে টিকা দিচ্ছে, তাতে এই বছর নাগাদ ১৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব।
পূর্ববর্তী পোস্ট
চুয়াডাঙ্গায় করোনায় মৃতের সংখ্যা ২’শ ছাড়ালো : একদিনে সুস্থ ১২০জন
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ