স্টাফ রিপোর্টার: দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়েছে। টানা চার দিন দৈনিক দুই হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত পর গত ২৪ ঘণ্টায় কিছুটা কমে ১৮৯৭ হয়েছে। তবে মৃত্যু বেড়ে ৫ দাঁড়িয়েছে। এই ঊর্ধ্বমুখী ধারার প্রকোপ মোকাবিলায় সরকারের একাধিক দপ্তর বেশ কিছু বিধি-নিষেধ দিয়েছে। কিন্তু করোনার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের তুলনায় এবার স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে বিধিনিষেধগুলো কার্যকরের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষার দায়ে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। বাস্তবে এগুলো কাগুজে নির্দেশনায় পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশি¬ষ্টরা। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন এখনই ভাইরাসটির লাগাম টানতে না পারলে সংক্রমণ পরিস্থিতি ফের ভয়াবহ হতে পারে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায় করোনার চতুর্থ ঢেউ মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে তেমন আগ্রহ নেই। এ ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কার্যকর তৎপরতাও প্রায় অনুপস্থিত। আগের ঢেউগুলোতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শপিংমলে জীবাণুনাশক টানেল প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। জনসমাগমপূর্ণ জায়গায় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ছিল। রেস্তোরাঁ, গণপরিবহণে আসন ফাঁকা রেখে বসা ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নো মাস্ক নো সার্ভিস বাধ্যতামূলক করা হয়। সভা-সমাবেশ, বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। হাসপাতাল, কলকারখানা, বাজারঘাটের মতো পাবলিক প্লেসে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক ছিল। কেউ স্বাস্থ্যবিধি পালনে অনীহা দেখালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক জরিমানার বিধান ছিল। এবার সেসব নিয়মকানুন বাস্তবায়নের ছিটেফোঁটাও নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ফাইলবন্দি নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছে না।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, ‘যেখানে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িয়ে আছে, সেখানে বরাবরই উদ্বেগ থাকে। চতুর্থ ঢেউ রোধে ইতোমধ্যে সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাস ট্রেন স্টেশন, কুরবানির পশুরহাটগুলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে দেখভালের কথা বলা হয়েছে। সঙ্গে সবারই সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের বিষয়টি আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এজন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে মনিটরিং টিম করা হবে। এদিকে দেশে গত এক দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত ১৬ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া টানা চার দিন পর দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই হাজারের নিচে এসেছে। তবে এদিনও ১ হাজার ৮৯৭ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। আগের দিন সোমবার দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়ায়। সেদিন ২ হাজার ১০১ জন শনাক্তের কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মঙ্গলবার ২ হাজার ৮৭ জন, বুধবার ২ হাজার ২৪১ জন এবং বৃহস্পতিবার ২ হাজার ১৮৩ জন রোগী শনাক্ত হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ঊর্ধ্বমুখী স্রোতের মধ্যে মানুষ কোনো বিধিনিষেধই মানছে না। মানানোর ব্যপারে তেমন উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘরে ঘরে সর্দি-কাশি, জ্বর হচ্ছে। জনঘনত্ব বেশি হওয়ায় করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু অনেকে সংক্রমিত হলেও বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে নতুন ধরন ওমিক্রনের সাব ভ্যারিয়েন্ট ১১০টি দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এরইমধ্যে কুরবানির ঈদ শুরু হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে বিপণিবিতানে ভিড় হবে। মানুষ গ্রামে যাবে। গণপরিবহণে চাপ বাড়বে। এতে ঢাকায় সংক্রমিত ব্যক্তি গ্রামে গিয়ে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেবে। এতে সামাজিক সংক্রমণ হবে। তাই করোনা রোধে সরকারি নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে তৎপর হতে হবে। গণহারে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও আফ্রিকায় সংক্রমণ বাড়ছে। দেশে জিনমো সিকয়েন্সে দেখা গেছে এই সংক্রমণ হচ্ছে ওমিক্রনের কারণে, যা রোধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি কমিটি ও ধর্ম মন্ত্রণালয় বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। তবে এবারের করোনা উপসর্গ মৃদু হওয়া, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু কম হওয়া অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানায় গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিন্তু যারা টিকা বা বুস্টার নেননি, যারা বয়স্ক, কোমরবিডি আছে তারা বেশ ঝুঁকিতে রয়েছেন। তিনি আরও বলেন, সামনে কুরবানির ঈদ, সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা আছে। ফলে বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, চিকিৎসক, পেশাজীবী, সুশীল সমাজ সবার সমন্বিতভাবে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণকেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। শ্যাডো ভ্যাকসিন হিসাবে, মাস্ক পরা, উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা পরীক্ষা ও আইসোলেশনে থাকতে হবে। সবাইকে টিকা নিতে হবে। জনস্বাস্থ্যবিদরা আরও বলেন, এই মুহূর্তে সরকারের কাজ হবে প্রতিটি লোকের মাস্ক পরা নিশ্চিত করা। কেউ বাইরে এলে মাস্ক ব্যবহার করছে কি না স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে তা মনিটরিং করা। এ কাজে সংসদ-সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য ও এলাকার ব্যক্তিদের জড়িত থাকতে হবে। এছাড়া ঘরের বাইরে, দোকানে, মসজিদের দরজার পাশে সাবান ও পানি বা স্যনিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কারও লক্ষণ দেখা দিলে আইসোলেশনে থাকা। পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা নেয়া। যারা অসুস্থ বা বয়স ষাটোর্ধ্ব তাদের দুই ডোজ টিকা ও বুস্টার ডোজ নিশ্চিত করতে হবে।