দেশি-বিদেশি জনশক্তির শ্রমের বিনিময়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তব
পদ্মা সেতুতে বসানো হল শেষ স্প্যান : সেতুতে গাড়ি ও ট্রেন চলাচলের অপেক্ষা
স্টাফ রিপোর্টার: পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়, এটি এখন বাস্তব ও দৃশ্যমান। বৃহস্পতিবার ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হল সেতুর মূল অবকাঠামো। এদিন বেলা ১২টা ২ মিনিটে মূল নদীতে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর ‘টু-এফ’ স্প্যানটি বসানোর কাজ শেষ হয়। এ সময় মাঝ পদ্মায় চলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয়দের আনন্দ-উল্লাস। ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে ছাইচাপা দিয়ে বাংলাদেশের পদ্মা জয়ে উল্লাসিত জনগণ। কেউ কেউ জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে ও গায়ে জড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। শেষ স্প্যানটির দুই পাশে ছিলো বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা। লাল ব্যানারে পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি ও চীনা ভাষায় লেখা ‘বহু বছরের প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি জনশক্তির শ্রমের বিনিময়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তব। সেতুর ৪১টি ইস্পাতের তৈরি স্প্যান সোনার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে সংযুক্তির মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বন্ধনকে অটুট রাখবে। এই স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা নদীর বুক চিরে দাঁড়িয়ে গেলো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সবচেয়ে বড় সেতু। সংযুক্ত হল মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত। বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করলো, দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়ন ছাড়াই ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
এখন দেশবাসীর অপেক্ষা- কবে এ সেতুতে গাড়ি ও ট্রেন চলাচল শুরু হবে। লঞ্চে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে মাওয়ায় আসা খুলনার বাসিন্দা আব্দুল জলিল বলেন, ব্যবসার কাজে প্রতি মাসেই ঢাকায় যেতে হয়। ফেরিতে গাড়ি পারাপারের সময় বেশি লাগে। তাই লঞ্চ বা স্পিডবোটে পদ্মা পাড়ি দিই। এতে ভাড়াও বেশি লাগে, পথে পথে বিড়ম্বনা সইতে হয়। তিনি সময় গুনছেন কবে নাগাদ সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরু হবে। কারণ সেতুতে গাড়ি চললেই কষ্ট থেকে রেহাই মিলবে। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দেন এই রুট ব্যবহারকারী আরও কয়েকজন। সেতু কর্তৃপক্ষ আশা করছে, সব ঠিক থাকলে ১০ থেকে ১২ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব না হলে ২০২২ সালের মাঝামাঝি খুলে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ সেতু চালু হলে খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষের ঢাকায় যাতায়াত সহজ ও দ্রুতগতির হবে। সরেজমিন দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্প্যান নিয়ে ভাসমান ক্রেন ‘তিয়ান-ই’ পিলারের খুব কাছে পৌঁছে যায়। তারপর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর স্প্যানটি বসানোর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১২টা ২ মিনিটে। সবশেষ স্প্যান বসানোর কাজ দেখতে অনেক মানুষ নৌকা, ট্রলার, স্পিডবোট ভাড়া করে সেতুর কাছাকাছি ভিড় জমান। এ সময় সেতুর নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যরা কয়েকটি স্পিডবোট নিয়ে পুরো এলাকা টহল দেন। স্প্যান বসানোর স্থানের কাছাকাছি যেতে দশনার্থীদের নিরুৎসাহিত করেন।
স্প্যান স্থাপনের কাজ যখন চলছিল তখন সেখানে উপস্থিত হন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ সময় তিনি মাওয়া ও কাঁঠালবাড়ীতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অবকাঠামোগত কার্যক্রম পরিদর্শন করছিলেন। তাকে বহন করা সার্ভে জাহাজ ‘বড়াল’ থামিয়ে তিনিও শেষ স্প্যান বসানোর দৃশ্য দেখেন। প্রায় আধা ঘণ্টা সেখানে অবস্থানের পর কাঁঠালবাড়ী ফেরিঘাটের উদ্দেশে রওনা হন।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, কাজ এগিয়ে রাখতে বুধবার বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে মাওয়া কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে স্প্যানটিকে নির্ধারিত পিলারের কাছে রাখা হয়। সেখানে ভাসমান ক্রেনের নোঙর করার কাজটিও সেরে ফেলেন প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা। সারারাত সেখানেই রাখা হয় স্প্যান বহনকারী ক্রেনটিকে। এ কারণে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই স্প্যান স্থাপনের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুতে বসে প্রথম স্প্যানটি। এরপর ২০১৮ সালে বসানো হয় চারটি স্প্যান, ২০১৯ সালে ১৪টি, ২০২০ সালে বসানো হয় ২২টি স্প্যান। প্রথম স্প্যান থেকে ধারাবাহিকভাবে বসিয়ে শেষ পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ৩৮ মাস ১০ দিন।
এদিকে ৪১তম স্প্যান বসানোর পর বৃহস্পতিবার বিকেলে সেতু বিভাগের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মূল সেতুর ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে ১ হাজার ৩৩৩টি এবং ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে ১ হাজার ৯৪২টি স্থাপন করা হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরা ভায়াডাক্টে ৪৮৪টি সুপার গার্ডারের মধ্যে ৩২১টি স্থাপন হয়েছে। মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি শতকরা ৯১ ভাগ। নদীশাসন কাজের বাস্তব অগ্রগতি শতকরা প্রায় ৭৬ ভাগ। ইতোমধ্যে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়কের শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি শতকরা ৮২ দশমিক ৫০ ভাগ।
সব ষড়যন্ত্রের জবাব পদ্মা সেতু- নৌপ্রতিমন্ত্রী : শেষ স্প্যানটি বসানোর সময় পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে কাঁঠালবাড়ী ফেরিঘাটে যাচ্ছিলেন নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছেন। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, চার লেন-ছয় লেনের মহাসড়ক, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছেন। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গকে মূল ভূখ-ের সঙ্গে যুক্ত করছিলেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সরাসরি সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রী পরে কাঁঠালবাড়ীর ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী ফেরিঘাট এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।
দ্রুত গাড়ি চলাচলের প্রত্যাশা : সরেজমিন দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারে যখন ৪১তম স্প্যানটি বসানো হচ্ছিল, সেখান থেকে একটু দূরে পিলারের নিচ দিয়ে চলছিল শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী রুটের ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট। নৌযানগুলোর যাত্রীদের সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে সেতুর কাজের অগ্রগতি দেখেন। এদের অনেকের কাছে শেষ স্প্যান বসানোর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বরিশালের বাকেরগঞ্জের বাসিন্দা মো. ছোলেমান সরদার বলেন, যত দ্রুত গাড়ি চলাচল শুরু হবে ততই আমাদের জন্য ভালো। বর্তমানে দুইবার গাড়ি পরিবর্তন করে ঢাকায় আসতে হয়। তিনি বলেন, প্রথমে বরিশাল থেকে গাড়িতে কাঁঠালবাড়ী আসি, সেখান থেকে স্পিডবোটে মাওয়া। এর পর আবারও গাড়িতে চড়তে হয় ঢাকায় যেতে। তিনি বলেন, দুইবার গাড়ি পরিবর্তনের কারণে কষ্ট হয়, লোকাল গাড়ির মানও ভালো নয়। সেতু খুলে দিলে সরাসরি গাড়ি চলবে, সেগুলোর মানও ভালো হবে, খরচও কম হবে। মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা শরিফুজ্জামান বলেন, প্রতি সপ্তাহে ব্যবসার কাজে ঢাকা আসি। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী রুটে স্পিডবোটের ভাড়া ১২০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও কখনও কখনও ১৫০ ও ২০০ টাকা আদায় করে। তাদের কাছে আমরা জিম্মি। সেতুতে গাড়ি চালু হলে স্পিডবোটের এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি মিলবে। তবে সেতুর কাজের অগ্রগতিতে মন খারাপ স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী, স্পিডবোট এবং লঞ্চ মালিক ও চালকদের। তারা জানান, সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরু হলে তাদের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।
পদ্মা সেতু ২০০১-২০২০ : ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষদিকে এসে সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৭ সালের একনেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প অনুমোদন পেলেও বারবার তৈরি হয় নানা জটিলা। এতে ব্যয় ও সময় দুই বেড়ে যায়। ২০০৭ সালে একনেকে যখন প্রকল্পটি পাস হয় তখন ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় ২০১১ সালে ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। প্রকল্পের বর্তমান ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। অপরদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সময়ও বারবার পিছিয়েছে। নকশা প্রণয়নের পর ২০১৩ সালে সেতু চালুর কথা ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের জটিলতায় ওই সময়ে কাজই শুরু করা যায়নি। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে চায়না রেলওয়ে ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। ৪৮ মাসে এ সেতু নির্মাণে চুক্তি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর এটি শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তিন দফায় ৩১ মাস পিছিয়ে ২০২১ সালের ৩০ জুন নির্ধারিত রয়েছে। যদিও করোনার প্রভাব ও সাম্প্রতিক বন্যাসহ নানা কারণ দেখিয়ে ২০২২ সালের ২৩ এপ্রিল পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বিশ্বব্যাংকের আপত্তি আটকাতে পারেনি পদ্মা সেতু : বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আটকাতে পারেনি পদ্মা সেতু নির্মাণ। নিজস্ব অর্থায়নেই এখন নির্মাণ হচ্ছে পদ্মা সেতু। যদিও ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তা অনুমোদন করে। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়। একই বছর ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। এতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও তার মালিকানাধীন কোম্পানি সাকোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ করা হয়। ওই অভিযোগের পর একপর্যায়ে প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করা হয়। অনুসন্ধান দল গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবুও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের ঋণ সহায়তা স্থগিতের ঘোষণা আসে। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে।