ঈদযাত্রায় সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ভাড়ায় চালিত বিভিন্ন যান
স্টাফ রিপোর্টার: করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণার পর অনেক কিছু খুলে দিলেও দূরপাল্লার গণপরিবহন এখনো বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঈদকে সামনে রেখে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি, পিকআপ, ট্রাক ও মোটরসাইকেলে চেপে অনেকে ঘরমুখী হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূরপাল্লার বাস বন্ধের মতো এসব ছোটখাট যানবাহন বন্ধ কিংবা চড়া নিরুৎসাহিত করতে না পারলে যেকোনো মুহূর্তে সংক্রমণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ফলে বিভিন্ন সময়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হবে।
সরেজমিন রাজধানীর গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, সদরঘাট, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড ঘুরে বাড়ি ফেরা বিভিন্ন জেলার মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। লকডাউনের কারণে দূরপাল্লার বাস না পেয়ে তারা মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, সিএনজি, পিকআপ ও ট্রাকে চড়ে নানা মাধ্যমে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পরিবারের ছোট শিশু ও বৃদ্ধদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই বাড়ির পথ ধরছেন। সংক্রমণ ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে দূরপাল্লার রুটে যাত্রী বহনকারী এসব পরিবহণ আটকে ট্রাফিক পুলিশকে মামলা দায়ের ও জরিমানা আদায় করতেও দেখা গেছে।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দূরপাল্লার গণপরিবহণ চলাচল না থাকায় অনেকে জরুরি প্রয়োজনে দীর্ঘদিন ধরে গন্তব্যে যেতে পারছেন না। এর সঙ্গে আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অনেকের মধ্যে গ্রামে যাওয়ার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ফলে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ রাইড শেয়ারিংয়ের মতো ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, অ্যাম্বুলেন্স, পিকআপ, মিনি ট্রাক ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত গাড়িতে চড়ে দূরপাল্লার উদ্দেশে রওয়ানা দিচ্ছেন।
জানতে চাইলে মাইক্রোবাসটির চালক আরিফুর রহমান বলেন, দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় রোজার ঈদকে সামনে রেখে এই এলাকার অনেক নির্মাণশ্রমিক, রিকশাচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ছোটখাট গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি যাচ্ছেন। দিনের বেলা দূরপাল্লার ভ্রমণে বিধিনিষেধ থাকায় রাতের দিকে কমপক্ষে চার-পাঁচটা গাড়ি ওই এলাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যাত্রী পরিবহন করছে। এভাবে ঢাকার সব জায়গা থেকেই খেটে খাওয়া স্বল্প আয়ের মানুষজন বাড়ি যাচ্ছেন। রাস্তায় পুলিশ গাড়ি আটকালেও কিছু টাকা-পয়সা দিলেই ছেড়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, লকডাউনে উবার-পাঠাও বন্ধ থাকায় অনেক রাইড শেয়ারিং চালকরা হাইওয়ে রোডে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলে গাদাগাদি করে যাত্রী নিচ্ছেন। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে দূরত্বভেদে মাথাপিছু ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় আরিচা, পাটুরিয়া, মাওয়া ঘাটসহ বিভিন্ন জেলায় যাত্রী পরিবহণ করছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় এসব পরিবহণে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে ছুটছেন।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে গত ২৫ এপ্রিল থেকে দোকানপাট এবং শপিংমলগুলো খুলে দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এ অবস্থায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানা হলে প্রয়োজনে সব দোকানপাট বা মার্কেট বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যেই সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান বিধিনিষেধ ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে প্রত্যেক জেলার মধ্যে গণপরিবহণ চলাচলে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। এই সুযোগে অনেকে মনে করছেন কোনো রকমে হাইওয়ে রোড বা মূল সড়ক পার হতে পারলেই জেলার মধ্যে চলাচলরত পরিবহণ সুবিধা পাবে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে দূরপাল্লার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে উপসর্গহীন করোনা পজেটিভ ব্যক্তির মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে ছোট পরিবহণে ঠাসাঠাসি করে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি কতোটুকু এবং তা মোকাবিলার উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কানাডা সরকারের সিনিয়র পলেসি বিশ্লেষক ডা. শাহরিয়ার রোজেন বলেন, গণপরিবহণে চলাচলের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অংশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে এটা নিয়ন্ত্রণ করা বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটি মৌলিক সমস্যা। উন্নত দেশে এই সমস্যা হয় না। এবার ঈদকে সামনে রেখে ইস্যুটা বড় করে দেখা দিয়েছে। কারণ সবকিছুই বন্ধ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া শুধু গণপরিবহন বন্ধ করলেই সমাধান হবে বিষয়টা এমন নয়। অফিস আদালত, শপিংমল সব খোলা রেখে কিছু সেবা বন্ধ, তা হয় না। তবে সরকার একটা কৌশল অবলম্বন করতে পারে। এজন্য এমন কাজ করতে পারে, যাতে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি পালনে আন্তঃজেলা পরিবহণ শ্রমিক সমিতি, মালিক সমিতি, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগ স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করতে হবে। জীবন বাঁচানোর স্বার্থে মানুষ যাতে সাময়িকভাবে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হয় সেই কাজ করতে হবে। যেমন পোশাক কারখানাগুলো তিন দিনের বেশি ছুটি না দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। এটা ভালো দিক। একইভাবে প্রাইভেট কারেও স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব মেনে শুধু পরিবারের লোকজন যেতে পারবে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মাইক্রোবাসগুলোতে অর্ধেক যাত্রী পরবিহণে বাধ্য করা যেতে পারে। তখন যাত্রী কম হওয়ায় বেশি ভাড়া ও পুলিশি বাধার কারণে অনেকে দূরপালস্নার পথে যেতে নিরুৎসাহিত হবে। প্রত্যেক জেলার বাস স্টেশনে চেকপোস্ট বসানো ও তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পরিকল্পনা গ্রহণের পর বিধিনিষেধ কার্যকর করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২০টা দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ায় অনেক দেশ ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে বিমান চলাচলা বন্ধ রেখেছে। সেখানে বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা অযৌক্তিক কিছু নয়। যদিও নতুন ধরনটি শনাক্তে সরকারি পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে আগে থেকেই সতর্ক হয়ে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন কেউ জানত না বাংলাদেশে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট থাকতে পারে; তখন আইসিডিডিআর’বির গবেষণায় দেখা গেলো বাংলাদেশে মোট সংক্রমণের ৮১ শতাংশ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। মূলত, মানুষের ভ্রমণের মাধ্যমে এটা ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে গণপরিবহণে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত জরুরি হয়ে পড়েছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ