ঢাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে ভবন ধসে নিহত ৩ : আহত অর্ধশত
নাশকতা নয় জমে থাকা গ্যাস থেকে দুর্ঘটনা-পুলিশ : ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল
স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর সায়েন্সল্যাবের একটি তিনতলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। রোববার মিরপুর রোডের শিরিন ম্যানসনের বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। ধসে পড়ে ভবনের একাংশ। লেগে যায় আগুন। তিনতলার দেয়াল ভেঙে নিচের সড়কে পড়ে নিহত হন তিনজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসহ আহত হন অর্ধশত। এর মধ্যে ১৩ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শক্তিশালী বিস্ফোরণের আঘাতে ভবনের তিনতলা থেকে কংক্রিটের টুকরো, ফার্নিচার, দরজা, শাটারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র রাস্তায় ছিটকে পড়ে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য যেন থমকে ছিল পুরো এলাকা। আহতদের চিৎকারে ভাঙে মুহূর্তের নিঃস্তব্ধতা। এরপর ধীরে ধীরে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দল ঘটনাস্থলে আসে। নিয়ন্ত্রণে আনে আগুন। নিহত-আহতদের নেয়া হয় আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে। চার ঘণ্টা পর নিউমার্কেট এলাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানিয়েছে, জমে থাকা গ্যাস থেকেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় নিহত শফিকুজ্জামান, আব্দুল মান্নান ও তুষার নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মী ছিলেন। এতে যারা আহত হয়েছেন তাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের অনেকেই শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের কেউ অগ্নিদগ্ধ, কেউ বিস্ফোরণের ফলে ছুটে আসা ইট, কাঠসহ বিভিন্ন বস্তুর আঘাতে আহত হয়েছেন। বার্ন ইনস্টিটিউটের মুখ্য সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘এখানে চিকিৎসাধীন পাঁচজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। বাকি দুজনের অবস্থা কিছুটা ভালো।’ ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালের পরিচালক ডা. এএসএম সারফুজ্জামান জানান, তার হাসপাতালে ভর্তি কয়েকজনের অবস্থাও গুরুতর।
ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মিরপুর রোডের ৩৪ নম্বর শিরিন ম্যানসনের ভবনের তৃতীয়তলায় ঘটনার সূত্রপাত। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে দোকান খোলার সময় হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। চারদিক ছেয়ে যায় ধোঁয়ায়। বেলা ১১টা ১৩ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। ভেতরে আটকে পড়া কাউকে না পেয়ে দুপুর দুইটার দিকে শেষ হয় উদ্ধারকাজ। আলামত সংগ্রহ করে ডিএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ও সেনাবাহিনীর একটি দল। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর তাদের প্রত্যেকেই বলেছে, এটি কোনো নাশকতার ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা। পুলিশ বলছে, চার কারণে ওই ভবনে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সেগুলো হলো- বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, জমে থাকা গ্যাস, গ্যাস সিলিন্ডার লিক এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের (এসি) কারণে। তবে ভবনে থাকা ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় তারা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন জমে থাকা গ্যাস থেকেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।
ঘটনাস্থলে এ বিষয়ে কথা বলেন ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রহমত উল্লাহ চৌধুরী। রোববার তিনি বলেন, গত দুদিন বন্ধ থাকার কারণে সেখানকার এসি কক্ষে গ্যাস জমা হয়। গ্যাসটি বাতাসের সঙ্গে ৫ থেকে ১১ মাত্রায় ছিল। সেখান থেকেই ভয়াবহ এই বিস্ফোরণ। এত বড় মাত্রার বিস্ফোরণ সাম্প্রতিক সময়ে খুব কমই দেখেছি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে শিরিন ম্যানসনের তৃতীয়তলা। সেখানের সবকিছুই বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের অফিস। ভবনের নিচের রাস্তায় পড়ে আছে চেয়ার, টেবিল, মোটা কাচের টুকরো, বিভিন্ন ফাইলপত্র, কার্টন, স্যান্ডেল, ফল বিক্রেতার ঝুড়িভর্তি পেঁপে, সাইনবোর্ডসহ অনেক কিছু। ঘটনার পর পুরো ভবনটি ঘিরে রেখেছিল পুলিশ সদস্যরা।
ভবনটির সিকিউরিটি গার্ড আব্দুল কাদির বলেন, ঘটনার সময় গেটে বসেছিলাম। হঠাৎ এমন বিস্ফোরণ হয় ভবনসহ আমার চেয়ার কেঁপে ওঠে। আশপাশের ভবনও কেঁপে ওঠে। সব অন্ধকার হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই ভবনের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে নিচে নামতে থাকেন। পরে বের হয়ে দেখি তিনতলা ভবনটির সামনে মানুষজন পড়ে আছে। সবকিছু ভেঙেচুরে গেছে।
বিস্ফোরণের মাত্রায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা বলছেন, সাধারণত এক্সপ্লোসিভ থাকলে এত শক্তিশালী বিস্ফোরণ হতে পারে। কারণ বিস্ফোরণের ফলে ওপর থেকে অনেকে ছিটকে নিচের মাটিতে পড়েছেন। কিন্তু বিস্ফোরকের অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও এমন বিস্ফোরণের ঘটনা বিস্ময়কর। এজন্য ভবনের দুর্বল অবকাঠামোকেও দায়ী করছেন তারা। রোববার বিকালে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়ে দেয় সিটি করপোরেশনের একটি দল।
শিরিন ম্যানসনের তৃতীয়তলায় তিনটি প্রতিষ্ঠান ছিল। সেগুলো হলো-নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড, লায়রা প্রডাক্টস ও ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি.। ভবনটি যে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল-এমন বক্তব্য উঠে এসেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের কাছ থেকেও। নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী আকরাম হোসেন বলেন, এর আগেও বেশ কয়েকবার ভবনের মালিককে ঝুঁকির বিষয়ে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
দুর্ঘটনার পর রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ভবনটির অবস্থা এখন পর্যন্ত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর তিনতলায় ছোট ছোট অফিস ছিল এবং একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিস ছিল। যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আমি মনে করি এই মুহূর্তে ভবনটিতে কারও প্রবেশ করা উচিত হবে না। আমরা ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছি, পরিদর্শন করেছি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেনাবাহিনীর কেমিক্যাল ডিজাস্টার রেসপন্স টিম (সিডিআরটি)। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এই দলের প্রধান মেজর কায়সার বারী তুষার বলেন, আমাদের যে সরঞ্জামাদি আছে এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, এখানে কোনো ধরনের বারুদের উপস্থিতি আছে কিনা। এছাড়া কোনো ধরনের আইইডি এতে ব্যবহার হয়েছিল কিনা তাও বুঝতে পারি। কিন্তু এমন কিছুই আমরা পাইনি।
বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে দুপুর আড়াইটায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে আমরা একটা কমিটি করব। তদন্ত কমিটি ফায়ার সার্ভিস এবং ঘটনাস্থলে কাজ করা এক্সপার্টদের ওপিনিয়ন (মতামত) নেবেন। পরে তারা একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মনে হচ্ছে এটি নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন।
এদিকে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র চিকিৎসাধীন আছেন। বিস্ফোরণের সময় তিনি ভবনটির নিচে ছিলেন। তখন ভারী কিছু পড়ে তার মাথা ফেটে যায় এবং ডান পা ভাঙে। আহত ছাত্রের নাম নূর নবী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ সার্জেন্ট জহরুল হক হলে। এখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।