ডলার সঙ্কটে মূল্য পরিশোধে সমস্যা : বাংলাদেশকে জ্বালানি না দেয়ার হুমকি

পেট্রোলের মজুত ১৬ থেকে ১৮ দিনের আর ডিজেলের মজুত আছে ৩০ থেকে ৩৫ দিনের

স্টাফ রিপোর্টার: ডলার সঙ্কটে আমদানি করা জ্বালানির মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। বর্তমানে ৬টি কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে ২৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার পাওনা রয়েছে। শুধু দুই কোম্পানির পাওনা ১৭ কোটি ডলারের ওপরে। নিয়ম অনুযায়ী তেল খালাসের ৩০ দিনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু অনেক কোম্পানির পাওনার মেয়াদ ৬০ দিন পেরিয়ে গেলেও বিপিসি দেনা পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে জ্বালানি আমদানিও কমছে। এ অবস্থায় জ্বালানির মজুত ‘বিপজ্জনকভাবে’ কমে আসছে। অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় ডিজেলবাহী একটি জাহাজ গভীর সমুদ্রে আটকে আছে। সংশ্লিষ্ট তেল কোম্পানির মালিক জানিয়েছেন, পেমেন্টে ছাড়া তেল খালাস করা যাবে না। এ অবস্থায় জ্বালানি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, একমাত্র জেট ফুয়েল ছাড়া বাকি জ্বালানিগুলোর মজুত দ্রুত কমে আসছে। বর্তমানে অকটেনের মজুত আছে ২০ থেকে ২৫ দিনের। পেট্রোলের মজুত ১৬ থেকে ১৮ দিনের। ডিজেলের মজুত আছে ৩০ থেকে ৩৫ দিনের। এই মজুতকে স্বাভাবিক বলছে বিপিসি। এলসি খোলা এবং তেল খালাস বাধাগ্রস্ত হলে তেলের মজুতে ঝুঁকি বেড়ে যাবে।

এদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পাঠানো দুটি চিঠির একটির সূত্র ধরে সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্স একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, ছয়টি আন্তর্জাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের কাছে জ্বালানি তেল বাবদ ৩০ কোটি ডলার পাবে। অর্থ না পাওয়ায় এদের কেউ কেউ বাংলাদেশে তেল পাঠানো কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তেলবাহী কার্গো ‘না পাঠানোর হুমকি’ দিয়েছে।  গত বছর গ্রীষ্মকালে জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ সংকট চরম আকার ধারণ করে বাংলাদেশে। এতে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপিসির ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে জ্বালানির মূল্য পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে। রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, এ পরিস্থিতিতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেন ভারতের পাওনা রুপিতে পরিশোধ করতে পারে, এর অনুমতি দিতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে বিপিসি। এ চিঠির বিষয়ে বিপিসি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেছে, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে যৌক্তিকভাবে ডলার ছাড়ে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। ৯ মে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিপিসি বলেছে, ‘দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকায় এবং সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সময়মতো আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে পারছে না।’ এর আগে গত এপ্রিলে পাঠানো আরেক চিঠিতে বিপিসি বলেছে, ‘মে মাসের তফশিল অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি করা না গেলে দেশব্যাপী সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে, সেই সঙ্গে জ্বালানির মজুত বিপজ্জনকভাবে কমে যেতে পারে।’ ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে সর্বোচ্চ ১২৭ ডলার ছাড়িয়ে যায়। জ্বালানির দাম বাড়ায় জাহাজ ভাড়া বেড়ে যায় প্রায় শতভাগ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে অন্যান্য পণ্যের দাম। আমদানি ব্যয় মেটাতে চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান না থাকায় এর দামও বেড়ে যায়। এতে আমদানি ব্যয় বাড়ে লাগামহীনভাবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার ছাড়ে। এতে রিজার্ভ কমে যায়। প্রতিমাসেই তা কমছে। বর্তমানে রিজার্ভ কমে ৩ হাজার ১১৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের মতো।

এদিকে রয়টার্সের সংবাদে আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় মেটাতে চলতি অর্থবছরে বিপিসিকে ৫০০ কোটি ডলার এবং এলএনজি আমদানিতে পেট্রোবাংলাকে ২০০ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। এছাড়া ঋণপত্র খুলতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও ৩০০ কোটি ডলার দেয়া হয়েছে।’  বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা সবকিছু যৌক্তিকভাবে ব্যবস্থাপনা করছি। বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। নানা উত্থানপতন সত্ত্বেও আমরা ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ সংরক্ষণ করছি।’

সূত্র জানায়, বিপিসি প্রতিমাসে পাঁচ লাখ টন পরিশোধিত তেল ও এক লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিপিসি জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৭৬৪ কোটি ডলারের এলসি খুলেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে আমদানি করা হয়েছে ৭৮০ কোটি ডলারের জ্বালানি তেল, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও আমদানি ব্যয় বেড়েছে তুলনামূলকভাবে কম। ফলে পরিমাণতগভাবে জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে।

জানা যায়, যে ছয় কোম্পানির কাছ থেকে বাংলাদেশ তেল কিনছে, সেগুলো হলো চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি সিনোপেকের বাণিজ্যিক অংশীদার ইউনিপেক, ভিটল, এনোক, ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন (আইওসি), পেট্রো চায়না ও ইন্দোনেশিয়ার বিএসপি। এর মধ্যে ভারতীয় কোম্পানির বকেয়া সে দেশের মুদ্রা রুপিতে পরিশোধ করার প্রস্তাব দিয়েছে বিপিসি। কিন্তু তেল রপ্তানিকারক কোম্পানি রুপিতে পেমেন্টে নেবে কি না, সেটা নিয়ে আগে আলোচনা করা দরকার বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর রুপিতে পেমেন্ট দেয়ার মতো যথেষ্ট রুপি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে নেই। কারণ, ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি কম। রেমিট্যান্সও কম আসে। যেটুকু আসে, সেগুলোর বড় অংশই আসছে ডলারে।

বিপিসির ৯ মের চিঠি অনুযায়ী, চলতি বছর ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারিকে ৪ কোটি ১১ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে বিপিসিকে; আইওসিকে ডিজেল ও জেট ফুয়েল বাবদ দিতে হবে ১৪ কোটি ৭২ লাখ ডলার। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেন ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে রুপিতে অর্থ পরিশোধ করতে পারে, তার অনুমতি দিতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে বিপিসি।

এদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ডলার স্বল্পতার কারণ দেখিয়ে কয়েক মাস ধরে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর ১৫০ কোটি ডলার মূল্যমানের বিল পরিশোধ করছে না।

বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফয়সাল খান বলেছেন, ‘এ বিলম্বের কারণে অনেক স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে; এর প্রতিকার না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হতে পারে।’

এ বিষয়ে বিপিডিবির মুখপাত্র শামিম হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিল পরিশোধের প্রক্রিয়াটি চলমান। যত দ্রুত সম্ভব বিল পরিশোধের চেষ্টা করছি; কিন্তু অন্যদের মতো বাংলাদেশও ডলার সংকটে আছে। এ কারণে দেরি হচ্ছে।’

জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোও জ্বালানি তেল আমদানির বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না। তবে তেল আমদানির এলসি খোলা হচ্ছে। এদিকে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি গ্যাস ও কয়লাও আমদানি করতে হচ্ছে। এতেও খরচ হচ্ছে বাড়তি ডলার।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More