ট্রেনে নাশকতার আগুনে মা-ছেলেসহ নিহত ৪ : তদন্তে কমিটি গঠন

নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের’ ৩টি বগি পুড়ে গেছে
স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা হরতালের আগের রাতে ঢাকায় একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে দেয়া আগুনে মারা গেছেন মা-ছেলেসহ চারজন। মঙ্গলবার ভোর ৫টায় রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে এ ঘটনা ঘটে। এতে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের’ ৩টি বগি পুড়ে গেছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তেজগাঁও রেলস্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার পর্বত আলীর ভাষ্যমতে, নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নামে ট্রেনটি কমলাপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ট্রেনটি সব স্টেশনে থামে না। সবশেষ ট্রেনটি থেমে ছিল ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রেলস্টেশনে। রাত চারটার দিকে তেজগাঁও রেলস্টেশন থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে ছিল ট্রেনটির অবস্থান। তখন ট্রেনটি আসছিল। ট্রেনের হেডলাইটের আলো দেখে এবং অভিজ্ঞতা থেকে ট্রেন কতদূরে আছে তা অনুমান করতে পারি। ট্রেনটি এই স্টেশনে যেহেতু থামে না, তাই আমি আগেই সবুজ পতাকা নেড়ে সংকেত দিচ্ছিলাম।
তিনি বলেন, স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই ট্রেনের মাঝামাঝি তিনটি বগিতে আগুন দেখতে পাই। সেই সঙ্গে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। আমি দ্রুত সবুজ পতাকা ফেলে কম্পিউটার রুমে গিয়ে ট্রেন লাইনে বিপজ্জনক লাল সিগন্যাল বসিয়ে দেই। যাতে কমলাপুর স্টেশন কর্তৃপক্ষ ট্রেনে বা রেললাইনে বিপদের বিষয়টি বুঝতে পারে। এভাবেই ট্রেনের বিপদ সম্পর্কে জানানো হয়। একই সঙ্গে কমলাপুর রেলস্টেশন ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেই। আগুন আগুন বলে চিৎকার শোনার পর চালক ট্রেনটি থামিয়ে দেন। ততক্ষণে ট্রেনের ভেতরে আগুন আগুন বলে যাত্রীদের কান্নার রোল পড়ে যায়। এ সময় আতঙ্কে যে তিনটি বগিতে আগুন লেগেছে সেই বগিগুলো থেকে অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন লাফিয়ে পড়েন।
চোখের পলকে তিনটি বগিতে পুরোপুরি আগুন ধরে যায়। ঘটনার সময় অনেকেই ঘুমে ছিলেন। চিৎকার ও কোলাহলে অনেকেই আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠলেও তারা কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ভেতরে দগ্ধ মানুষের আহাজারি শোনা যাচ্ছিল।
তিনি আরও বলেন, আমার ধারণা যখন সবুজ পতাকা নেড়ে সংকেত দিচ্ছিলাম, তখন ট্রেনের গতি ছিল কমপক্ষে ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার। অনেক আগে ট্রেনে আগুন দিয়ে এত দ্রুতগতির ট্রেন থেকে কারও পক্ষে নেমে পালিয়ে যাওয়া কঠিন। নামতে গেলে হতাহতের ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো সুযোগ বুঝে তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনের আগেই ট্রেনে আগুন দিয়েছে নাশকতাকারীরা। এমন সময় আগুন দিয়েছে, যাতে ট্রেন থামতে বাধ্য হয়। নাশকতাকারীরা যাত্রীদের সঙ্গে হুড়োহুড়ির সুযোগে নেমে ভিড়ে মিশে পালিয়ে গেছে।
তেজগাঁও রেলস্টেশনের মাস্টার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ট্রেনটিতে ইঞ্জিন ছাড়া মোট ১৫টি বগি ছিল। ইঞ্জিনের পেছনে থাকা ৬টি বগি পরে ছ, জ ও ঝ নম্বর বগিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। বগি তিনটির ক্লাস ছিল শোভন চেয়ার। তিনটি বগি পুরোপুরি পুড়ে গেছে। ট্রেনে প্রায় ৯০০ যাত্রী ছিল। কারণ গড়ে প্রতিটি বগিতে অন্তত ৬০ জন করে যাত্রী থাকে। কোনটিতে আবার কম-বেশিও থাকে। তবে কোনো বগিতেই যাত্রীর সংখ্যা সাধারণত ৬৭ থেকে ৭০ জনের ওপর থাকে না।
তিনি বলছেন, কেন বা কিভাবে আগুন লেগেছে তা জানা যায়নি। তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেনে আগুন লাগেনি। কারণ ট্রেনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাধারণত চাকায় আগুন লাগে। পরে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ট্রেনের চাকায় কোনো আগুন লাগেনি। আগুনটি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কে বা কারা কি উদ্দেশে রাষ্ট্রীয় এই পরিবহণে আগুন লাগিয়েছে সেটি জানা যায়নি। জানার চেষ্টা চলছে। তেজগাঁও রেলস্টেশনে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। যে কারণে নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কোনো তথ্য স্টেশন কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।
সরেজমিন দেখা গেছে, মাত্র দুটি সিসি ক্যামেরা আছে স্টেশন এলাকায়। যা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। ক্যামেরা দুইটি মূলত তাদের মালামাল দেখভাল করার কাজে ব্যবহৃত হয় বলে জানিয়েছেন সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা। একটি সিসি ক্যামেরা স্টেশনের গেটের দিকে মুখ করে লাগানো। সেই সিসি ক্যামেরা ঘোরে না। এজন্য শুধু স্টেশনে প্রবেশ বা বের হওয়া ব্যক্তিদের এক নজর দেখা যায়। এর বেশি আর কিছুই দেখা যায় না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মিডিয়া কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার জানান, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের ৩টি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়। সরু রাস্তা আর খানাখন্দের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছতে ৫টা বেজে যায়। পরে দ্র¤œততার সঙ্গে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়। সকাল পৌনে ৭টার দিকে আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা সম্ভব হয়। আগুনে ট্রেনের তিনটি বগি পুরোপুরি পুড়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, অগ্নিনির্বাপণ শেষ করার পর বগিতে তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় বগিগুলো থেকে উদ্ধার হয় চারজনের লাশ। অধিকাংশ লাশই পুড়ে অনেকটাই কয়লার মতো হয়ে গেছে। এর মধ্যে মা ও তার শিশু সন্তানের লাশের কিছুটা অংশ আছে। অন্য দুইজনের লাশ প্রায় কয়লা হয়ে গেছে। পরে উদ্ধার করা লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে জানা গেছে, নিহতদের পরিবার দুজনের পরিচয় শনাক্ত করে। নিহতের পরিবারের সদস্য রায়হান যায়যায়দিনকে বলেন, পরিচয় শনাক্ত হওয়া দুজন হচ্ছেন মা নাদিরা আক্তার পপি (৩৫)। তার তিন বছরের শিশুপুত্র ইয়াসিন রহমান। তাদের বাড়ি নেত্রকোনা সদর থানাধীন বরুনা গ্রামে। নিহত শিশুটির পিতার নাম মিজানুর রহমান। তিনি ঢাকার কারওয়ান বাজারে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন।
মর্গ সূত্রে জানা গেছে, নিহত অপর দুইজন পুড়ে প্রায় কয়লা হয়ে গেছে। তাদের লাশ মর্গেই রাখা হয়েছে। এ দু’জনের বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে হতে পারে। তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের শরীর থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জানান, ধারণা করা হচ্ছে ট্রেনটি সবশেষ থেমেছিল বিমানবন্দর স্টেশনে। সেখান থেকেই হয়তো নাশকতাকারীরা যাত্রীবেশে অথবা রেলওয়ে বিভাগের পোশাকের মতো নকল পোশাক পরিধান করে ট্রেনে ওঠে। আর তেজগাঁও রেলস্টেশনে ট্রেন পৌঁছার আগ মুহূর্তে তিনটি বগিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর অন্য যাত্রীদের সঙ্গে মিশে ট্রেন থেকে নেমে যেতে পারে। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়েছে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, পর্যালোচনায় দেখা গেছে তিনজন স্টেশনটি থেকে তিনটি বগিতে ওঠে। ধারণা করা হচ্ছে, তারাই হয়তো ট্রেনে পেট্রোল বা অকটেন জাতীয় বা অন্য কোনো মারাত্মক ধরনের দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে থাকতে পারে। আগুন ছড়িয়ে পড়লে চিৎকার চেঁচামেচির এক পর্যায়ে যাত্রীদের সঙ্গে তারাও নেমে পালিয়ে যায়। তেজগাঁও স্টেশন থেকে কারা নেমেছেন তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
এদিকে ঘটনার পর থেকেই নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। ঘটনাস্থল ও ট্রেন থেকে প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশ, ডিবি পুলিশ, সিআইডির ফরেনসিক টিম, পিবিআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। সংগৃহীত আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More