টাইম স্কেল ও জ্যেষ্ঠতা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানসহ বিভিন্ন দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান
নানা জটিলতায় এখনও মুক্তি মেলেনি জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের
স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা টাইমস্কেল ও জ্যেষ্ঠতা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানসহ বিভিন্ন দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা। গতকাল রোববার চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ সারাদেশে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষক মহাজোটের ব্যানারে এ কর্মসূচি পূর্বে ঘোষণা করা হয়। শিক্ষকরা বলেন, শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণের জন্য চাকরিকাল গণনা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাদির প্রাপ্যতার বিষয়ে ১২ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় যে পরিপত্র জারি করেছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়া তাদের পদোন্নতি ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সিলেকশন গ্রেড নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা। এসব সমস্যার সমাধান চান তারা। প্রাথমিক শিক্ষক নেতারা জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়ার পর ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবেন। এর মধ্যে সুরাহা না হলে ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন শেষে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেবেন তারা।
চুয়াডাঙ্গায় গতকাল রোববার সকাল ১০টার দিকে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। জেলা প্রশাসকের পক্ষে স্মারকলিপি গ্রহণ করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুনিরা পারভীন। স্মারকলিপি প্রদানে নেতৃত্বে ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলার জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষক মহাজোটের সমন্বয়ক ইসলামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফ আলী, দামুড়হুদা উপজেলার ডুগডুগি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকবর আলী, জীবননগর উপজেলার জীবননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মশিউর রহমান, আলমডাঙ্গা উপজেলা বকশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রহমতুল্ল্যাহ, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নীলমনিগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজির হোসেন, সহকারী শিক্ষক খালিদ হাসান জাহাঙ্গীর, বহালগাছি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দীন মৃধা, ৬২ আড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, পীরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহামুদুন্নবী, জালশুকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রজব আলী, সরিষাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুল আলম সোনা প্রমুখ।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণ করেন। ফলে লক্ষাধিক শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ হয়। এর মধ্যে ৬১ হাজার শিক্ষক টাইমস্কেল প্রাপ্য। তাদের চাকরি ১৯৭৪ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী সরকারি হয়। কিন্তু গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে যে অধ্যাদেশবলে জাতীয়করণ হয়েছে, তা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দেখানো হয়। ২০১৩ সালের অধ্যাদেশে ‘কার্যকর চাকরিকাল’ গণনা, জ্যেষ্ঠতা ও টাইম স্কেলের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশকে এখন প্রযোজ্য বলা হচ্ছে। ফলে ৪৮ হাজার ৭২০ শিক্ষককে টাইমস্কেল ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পৌনে আট বছরেও নানা জটিলতা থেকে মুক্তি পায়নি। আইন ও বিধির অপব্যাখ্যার কারণে বঞ্চিত করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতা থেকেও। দেয়া হয়নি প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব। সর্বশেষ তারা আর্থিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রায় অর্ধলাখ শিক্ষককে টাইম স্কেল ফেরত দিতে বলা হয়েছে। তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করার পথও তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষক মহাজোটের নেতারা অভিযোগ করেন, কিছু অসাধু কর্মকর্তার লোভের বলি তারা। ২০১৭ সালে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলে জাতীয়করণকৃত স্কুলের শিক্ষকদের বঞ্চিত করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) অসাধু কর্মকর্তারা তাদেরকে জ্যেষ্ঠতার তালিকায় রাখেননি।
এর সূত্র ধরে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তারা তাদের টাইমস্কেল প্রাপ্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কেননা বেসরকারি চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা ধরেই দেয়া হয় টাইমস্কেল। যদি মূল মন্ত্রণালয়ই অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে তালিকা করে; তাহলে টাইমস্কেল নিয়ে তাদের দাবি অযৌক্তিক নয়। এতে লক্ষাধিক শিক্ষক আইন ও বিধির অপব্যাখ্যা এবং ভুলের শিকার হচ্ছেন।
জানা গেছে, সহকারি শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়াকে কেন্দ্র করে এই জটিলতার উদ্ভব। ২০১৭ সালে প্রায় ১৮শ’ শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন মাঠপর্যায় থেকে সহকারী শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ তালিকা পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু ডিপিই’র শীর্ষ কর্মকর্তারা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের ডেকে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চাকরিকাল ধরে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করতে মৌখিক নির্দেশ দেন। ফলে জাতীয়করণ শিক্ষকরা পিছিয়ে পড়েন। অথচ ২০১৩ সালের অধ্যাদেশের ৯ নম্বর ধারায় বেসরকারি চাকরি জীবনের অর্ধেক সময় ‘কার্যকর চাকরিকাল’ বলে নির্দেশনা আছে।
ঘটনার পর উচ্চ আদালতে মামলার পাশাপাশি আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষকরা। তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানায়, জাতীয়করণ শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ বিধিসম্মত হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই চিঠি কে বা কারা পৌঁছে দেয় মহা হিসাবনিরীক্ষকের দফতরে। এরপর ফের শুরু হয় জটিলতা।
শিক্ষক নেতারা বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল জাতীয়করণকৃত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। কেননা প্রায় আট বছর হতে চললো কিন্তু জাতীয়করণের গোটা কাজ শেষ হয়নি বরং নতুন জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে।
শিক্ষক নেতারা মনে করেন, চক্রটি প্রধানমন্ত্রীর ভালো কাজের সুফল নষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত। এর বিরুদ্ধে তারা রাজপথে আন্দোলন, আলোচনা এবং আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। শিক্ষকরা কেবল জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতিবঞ্চিত হচ্ছেন না, টাইমস্কেল বাবদ গৃহীত পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকাও ফেরত দিতে হবে।