স্টাফ রিপোর্টার: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি নেই। এরমধ্যেই আজ বুধবার বিধিনিষেধ (লকডাউন) শিথিল হয়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, শিল্প-কারখানা, দোকান-শপিংমলসহ প্রায় সবকিছু খুলেছে। মহামারি থাকলেও মানুষের জীবিকা রক্ষা ও অর্থনীতির কর্মকা- সচল রাখার তাগিদ রয়েছে সরকারের ওপর। সংকটে পরা বিভিন্ন পেশার মানুষও আর মানতে চাচ্ছে না বিধিনিষেধ। তাই জীবিকা ও অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে আপাতত লকডাউন থেকে সরে এসেছে সরকার। এই প্রেক্ষাপটে মাস্ক পরাসহ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং বিপুল সংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা করতে চাইছে সরকার।
তবে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ করোনা মোকাবেলায় সরকারের এই কৌশলের সঙ্গে একমত নন। আবার কেউ কেউ বলছেন, আমাদের মতো দেশে বেশিদিন লকডাউন রাখা সম্ভব নয়। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ক্ষেত্রে সফল হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান বলেন, ‘আমাদের মতো দেশে লকডাউন প্রোপারলি করা সম্ভবই না। শ্রমজীবী মানুষ, রিকশাওয়ালা লকডাউন দিলে সে খাবে কী? তার খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। না পারলে সে বলবে করোনা হয়ে মরার ভয়ে আমি বের হবো না, আমি তো তার আগেই না খেয়ে মরে যাবো। এটা তো চিন্তা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘তবে একটা কাজ করলে সাবসটেন্সিয়াল লকডাউনে ইফেক্ট পাওয়া যেত, তা হলো- মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা। মাস্ক না পরে বাইরে এলেই শাস্তি পেতে হবে। এছাড়া যাদের মাস্ক নেই, সরকার তাদের মাস্ক সরবরাহ করবে। এটা বাস্তবায়ন করলে বড় সুফল পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি। লোকজন যেখানে দিন আনে দিন খায়, সেখানে তো দীর্ঘমেয়াদে লকডাউন দেয়া সম্ভব নয়।’ ‘করোনাভাইরাসে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে না। করোনা নিয়েও মানুষ বেঁচে থাকবে। তাই আমরা করোনা নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকব সেটা হলো কথা! মূল কৌশল হলো সকল মানুষকে টিকা দিয়ে ফেলা’ বলেন জাতীয় অধ্যাপক আজাদ খান। তিনি আরও বলেন, ‘ভ্যাকসিন কতোদিন ইফেকটিভ সেটাও ওয়ার্কআউট করা হয়নি। অনেক দেশে তো তৃতীয় ডোজ দিতে শুরু করেছে, যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এটা অনুমোদন করেনি। তাই এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশের নিজের তৈরি করা উচিত।’
জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিজ্ঞোচিত নয়। অবাধ চলাচলের সুযোগ করে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত করোনা পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলতে পারে।’
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখতে ও নিম্নআয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে বিধিনিষেধ শিথিলের এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও শনাক্তের হার ও মৃত্যুর হারের বিষয়ে আমাদের নজর রাখতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু দোকানপাট খুলতে হবে- সবাই যাতে স্বাস্থ্যবিধি মানে সেদিকে আমাদের জোর থাকবে। গণটিকা চালু করেছি, এটি ১২ আগস্ট পর্যন্ত চলমান থাকবে। আমরা চাইব সবাই যেন মাস্ক পরে।’
গত ৩ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সভায় মাস্ক না পরলে শাস্তির বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে আগামীতে কোনো নির্দেশনা পাবো, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। মানুষকে সচেতন করে পাড়া-মহল্লার করোনা প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে আরও কার্যকর করে মানুষ যেন মাস্ক পরে, জনসমাগম এড়িয়ে চলে সেটা দেখতে বলা হয়েছে। বিভিন্ন কমিটি এটি নিয়ে কাজ করছে। আগামীতে মাস্ক পরা নিশ্চিতে তারা কাজ করবেন।’
বিধিনিষেধ শেষে আজ বুধবার থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মোটামুটি সবকিছু খুলছে। গত ৮ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে আটটি শর্ত দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ সময় আসন সংখ্যার সমান যাত্রী নিয়ে চলবে সব ধরনের গণপরিবহন। তবে সড়কপথে স্বাভাবিকে চেয়ে অর্ধেক গাড়ি চলবে। এই সিদ্ধান্তটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বলা হচ্ছে গাড়ি কম চললে যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়বে, গাদাগাদি করে যেতে হবে। এতে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হবে না।
তবে আগের বিধিনিষেধের ধারাবাহিকতায় পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান (ওয়ালিমা), জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও বন্ধ থাকবে। সকল সরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত/বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে খোলা থাকবে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে। (ইতোমধ্যে জারি করেছে)। সড়ক, রেল ও নৌপথে আসন সংখ্যার সমপরিমাণ যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন/যানবাহন চলাচল করতে পারবে। সড়ক পথে গণপরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন (সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক) নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংশ্লিষ্ট দফতর/ সংস্থা, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিদিন মোট পরিবহন সংখ্যার অর্ধেক চালু করতে পারবে। শপিংমল/মার্কেট/দোকানপাট সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে খোলা রাখা যাবে। সকল প্রকার শিল্প-কলকারখানা চালু থাকবে। খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁয় অর্ধেক আসন খালি রেখে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। সবক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রণীত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। গণপরিবহন, বিভিন্ন দফতর, মার্কেট ও বাজারসহ যেকোনো প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে অবহেলা পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব বহন করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরও ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ২৩ হাজার ১৬১ জনে। এই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন আরও ১১ হাজার ১৬৪ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১৩ লাখ ৭৬ হাজার ৩২২ জনে। গত বছরের (২০২০) ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয়। পরিস্থিতি ক্রম অবনতির দিকে যেতে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। ওই বছরের ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিলো। পরে ৩১ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস খুলে দেয়া হয়, চালু করা হয় গণপরিবহন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফের উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় গত ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা পর্যন্ত লকডাউন দেয় সরকার। তবে গণপরিবহন, মার্কেট খোলা রেখে এই লকডাউন ছিলো অনেকটাই অকার্যকর। পরে গত ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে আটদিনের কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়। কয়েক দফায় শিথিলতাও আনা হয় বিধিনিষেধে। শেষে গত ২৩ জুলাই থেকে ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। গত ৫ আগস্ট থেকে আরও পাঁচদিন বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়ানো হয়। গতকাল মঙ্গলবার রাত ১২টায় শেষ হচ্ছে সেই বিধিনিষেধ।
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ