জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস
সংস্কার থেকে সরা যাবে না : জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবাই মিলে চেষ্টা করবো
স্টাফ রিপোর্টার: ‘গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবাই মিলে চেষ্টা করবো’ উল্লেখ করে দেশের রাজনীতিকদের উদ্দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কারের ব্যাপারে আপনাদের (রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য শরিক) কাছ থেকে সহযোগিতা চাই এ কথা বলবো না, কারণ এটা আপনাদেরই কাজ। আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো করে দিলাম। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা আমার কাজ নয়। আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, আপনাদের বলতে হবে সমাজের কোন কাঠামো কেমন হবে কী করা দরকার। কোনটা এখনই করা যাবে আর কোনটা পরে করলে হবে। কিছু সংস্কার রদবদল প্রয়োজন হলে আপনারা বললেই রদবদল করা যাবে। ড. ইউনূস বলেন, সেই নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য কী আইন-কানুন লাগবে, কীভাবে আমরা অগ্রসর হবো সে প্রশ্ন মাথায় রেখে আমরা কিছু সংস্কার কমিশন করেছিলাম। তিনি বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের প্রধান ও তাদের সহকর্মী সদস্যরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সংস্কারটা যেন এমনভাবে হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। আইনগুলো ঠিক করে নিয়েছিলেন বলেই আমরা মজবুত কাঠামো ঠিক করতে পেরেছি যার ওপর ভিত্তি করে আমরা দেশ গড়ার কাজে নেমেছি। কাজেই তারা যেসব প্রস্তাব করবেন ও করেছেন সেগুলো তাদের অভিজ্ঞতা, তাদের পান্ডিত্য ও আলাপ আলোচনা মাধ্যমে করেছেন। কষ্ট করে সংস্কার ওস্তাদ তৈরি করার জন্য যারা সংস্কার কমিশনের এখানে উপস্থিত আছেন তাদের ও যারা উপস্থিত নেই তাদেরও ধন্যবাদ জানাই।’ অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এখন কাজ হলো কতোটুকু আমরা গ্রহণ করবো, কীভাবে দ্রুততার সঙ্গে করবো এবং অগ্রসর হবো। তারা তাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন এখন আপনারা আপনাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গ্রহণ বর্জন করবেন। তিনি বলেন, আপনারা জনগণের নেতা, রাজনৈতিক দলের নেতা। আপনাদের প্রতিনিয়ত এ আইনগুলো নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। আলোচনা শুরুর জন্য সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো আপনাদের সামনে দেওয়া হয়েছে। আলোচনা একাডেমিক নয় বাস্তব আলোচনা। কোনটা কাজে লাগাতে পারবো, কোনটা লাগবে আর কোনটা লাগবে না, কোনটা কতটুকু সংশোধন করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আইনগুলো এমনভাবে তৈরি করা হবে যেন সবাই সেটা মেনে চলবে, মেনে চলার মাধ্যমে আমরা একটা সুন্দর সমাজ, সুন্দর রাষ্ট্র গড়তে পারবো। সে উদ্দেশ্যে আজ বসা। কীভাবে সংলাপ চলবে, সে সম্পর্কে আপনারা ধারণা দেবেন। এটাকে কেন্দ্র করে আমরা একটি ছোট্ট ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা কমিশন করেছি, কমিশনের প্রধানকে এখানে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, কারও ওপর চাপিয়ে দেয়া নয়, ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগুলো গ্রহণ করতে হবে ও কাজে লাগাতে হবে। এই যে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হচ্ছে এটা একটা বড় সুযোগ। সুযোগ এজন্যই যে আমরা এমন একটা পর্যায়ে রয়েছি, আমাদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি হলে এগুলো কাজে লাগাতে পারব এবং এবার কাজে লাগালে সেটা বংশ-পরম্পরায় সেটা চলতে থাকবে। একটা সুন্দর দেশ আমরা পাব। এ ভাবনা থেকে আমরা এগুলো গ্রহণ করব। সেই আলোচনাটা কত মসৃণ হবে সুন্দর হবে আপনারা স্থির করবেন। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সুপারিশগুলো আপনাদের সামনে নিয়ে এসেছি। সংস্কার কমিশনের সদস্যরা আমাদের সঙ্গে বসে এগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। চাপানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু আপনাদের বোঝাবো কেন করা হয়েছে, কী কারণে করা হয়েছে। সেদিক থেকে আমরা অ্যাপ্রোচ করব এবং জিনিসটিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’ এদিন বিকাল ৩টায় বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এটি কমিশনের প্রথম বৈঠক। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), নাগরিক ঐক্য, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। আহ্বায়ক নাসীররুদ্দীন পাটোয়ারির নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক কমিটিও এই বৈঠকে অংশ নিয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান। বৈঠকে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন- জমির উদ্দিন সরকার, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন- নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য মশিউল আলম। ইসলামী আন্দোলনের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমেদ ও যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। খেলাফতে মজলিশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন- আমীরে মজলিশ মাওলানা আবদুল বাছিদ আজাদ ও মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ বিবেচনা ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ছয় কমিশনের পুরো প্রতিবেদন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গেও কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কথার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে কতটুকু সংস্কার দ্র¤œত করতে হবে, কতটুকু পরে করা যাবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ প্রণয়ন করবে সরকার। এ জাতীয় সনদের ভিত্তিতে হবে নির্বাচন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্রসংস্কার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন অন্তর্বর্তী সরকার। অক্টোবরে গঠিত এসব কমিশনের মধ্যে ১৫ জানুয়ারি প্রাথমিক প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয় চারটি সংস্কার কমিশন। এরমধ্যে জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ ছাড়া বাকিগুলো গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। জনপ্রশাসন ও বিচার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর কমিশনগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। পরে ১২ ফেব্র¤œয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এতে সহসভাপতি হিসেবে আছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বুধবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদের স্বাক্ষরে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.