ঘুরলো স্বপ্নের মেট্রোরেলের চাকা : আজ থেকে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত
নিজে টিকিট কেটে ট্রেনে উত্তরা থেকে আগারগাঁও গেলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা
স্টাফ রিপোর্টার: ঘুরলো স্বপ্নের মেট্রোরেলের চাকা। বুধবার সকালে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে দেশের দ্রুতগতির এই গণপরিবহণ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক গণপরিহণের যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ। এদিন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, ঢাকার দুই সিটি মেয়র, সংসদ সদস্য ও নানা শ্রেণি-পেশার গণ্যমান্য প্রায় ২০০ যাত্রী নিয়ে ট্রেনে চড়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ট্রেনে তাদের গন্তব্যে নিয়ে যান মরিয়ম আফিজা ও আসমা আক্তার নামের দুই নারী চালক। ইতিহাসের সাক্ষী হতে আগারগাঁও ও উত্তরা স্টেশনের আশপাশে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। তারা নেচে-গেয়ে স্লোগান দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। আজ থেকে সাধারণ যাত্রী চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকছে মেট্রোরেল। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনো স্টেশনে না থেমে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সরাসরি যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারবেন। মঙ্গলবার থাকবে সাপ্তাহিক ছুটি। আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই সময়সূচি বহাল থাকবে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণার পর সুধী সমাবেশে বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর উত্তরা উত্তর স্টেশনে গিয়ে মেট্রোরেলের নামফলকের উন্মোচন করেন এবং সেখানে একটি গাছের চারা রোপণ করেন। এ প্রক্রিয়া শেষ করে নিজে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে ট্রেনের মেট্রোপাশ কেনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। তবে আমন্ত্রিত অন্য অতিথিরা বিশেষ পাশে ট্রেনে ওঠেন। মন্ত্রিসভার সদস্য ও সহযাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার ছোট বোন উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে প্রায় ১৭ মিনিটে আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছান। এ সময় আগারগাঁও স্টেশনে সকাল থেকে অপেক্ষমাণ জনসাধারণের উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান শেখ হাসিনা। জনসাধারণও শুভেচ্ছা পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
বেলা ১টা ৫৬ মিনিটের দিকে দিয়াবাড়ী স্টেশন থেকে মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে। ২টা ১১ মিনিটে আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছায়। সেখানে পৌঁছানোর পর প্রধানমন্ত্রীসহ তার সফরসঙ্গীরা নেমে যান। আর দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী দিয়াবাড়ী স্টেশনে সবুজ পতাকা নাড়িয়ে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের চলাচলের আনুষ্ঠানিক যাত্রার সূচনা করেন। এর আগে বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী ফলকের প্রতিরূপ (রেপ্লিকা) জনসম্মুখে উন্মোচন করেন। প্রতিরূপ উন্মোচনের পর মোনাজাতে অংশ নেন।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৬ মার্চ থেকে সব মেট্রোস্টেশনে থেমে থেমে ট্রেন চলাচল করবে। আপাতত ৬ কোচবিশিষ্ট ১০টি ট্রেন চলবে। প্রতিটি ট্রেন সর্বোচ্চ ২০০ জন যাত্রী বহন করতে পারবে। ট্রেন কাটা, ওঠানামা ও চলাচলে মানুষের অভ্যস্ততা তৈরি হলে ঘন ঘন ট্রেন চলবে। যাত্রীও বেশি নেয়া হবে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মেট্রোরেল উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, কুড়িল, বনানী, মহাখালীসহ আশপাশের এলাকার সড়কগুলো বিশেষভাবে সাজানো হয়েছিলো। সড়ক বিভাজনে রঙবেরঙের ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন টানানো রয়েছে। আগারগাঁও এবং উত্তরার বাসিন্দারা নেচে, গেয়ে এবং স্লোগান দিয়ে মাতিয়ে রাখেন পুরো এলাকা। গতকাল দুপুরে উত্তরা উত্তর স্টেশনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা চলাকালীন অর্ধশত উৎসুক নারীকে বসে থাকতে দেখা যায়। তারা সবাই নতুন কাপড় পরে সেজে এসেছেন। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক পলক দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কড়াকড়ির কারণে প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে না পেরে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে যান। সরেজমিন আরও দেখা যায়, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের দুপাশের এলাকা এবং নিচের সড়কে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। উত্তরার সমাবেশস্থল এবং আশপাশের এলাকার আকাশে র্যাবের সতর্ক টহল লক্ষ্য করা যায়। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ট্রেন ছেড়ে গেলে র্যাবের হেলিকপ্টারও আগারগাঁও অভিমুখে উড়ে যেতে দেখা যায়। মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী আগারগাঁও স্টেশনমুখো রওয়ানা হলে উত্তরা স্টেশন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর আগারগাঁও স্টেশন হয়ে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে চলে গেলে আগারগাঁও স্টেশনও সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে ৬০ বছর বয়সি মো. কমর উদ্দিন আগারগাঁওয়ে এসেছেন মেট্রোরেল চলাচল দেখতে। গতকাল দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বপ্নের মেট্রোরেলের উদ্বোধন দেখতে পেরে তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করছেন। তিনি আরও বললেন, আমার স্কুলের আরও ৩ জন শিক্ষক আমার সঙ্গে এসেছেন। তাদেরও স্বপ্ন ছিলো মেট্রোরেলের উদ্বোধনের দিন ঢাকায় থাকবেন। যে কষ্ট করে আমরা মেহেরপুর থেকে ঢাকায় এসেছি এখন সেটাকে আর কষ্ট মনে হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ঢাকায় এসে আগের মতো আর যানজটের কবলে পড়তে হবে না।
দেশের প্রথম মেট্রোরেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানার সঙ্গী হতে পেরে এমপি-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, আমলা এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রথম মেট্রোরেলে প্রধানমন্ত্রীর সহযাত্রী হওয়ায় খুশি তারা। একই সঙ্গে স্বপ্নপূরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধনের দিন তাতে চড়তে পেরে খুবই ভালো লাগছে। মেট্রোরেল ঢাকাবাসীর যাতায়াতের ক্ষেত্রে ভালো কার্যকর হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি ছিল দিন বদল করবেন। এই মেট্রোরেলের মাধ্যমেই তিনি তার কথা রেখেছেন।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি খুবই আনন্দিত পদ্মা সেতুর পরে আমাদের এটি একটি বড় অর্জন। এই মেট্রোরেল আমাদের মর্যাদা আরও বাড়াবে, মানুষের কষ্ট লাঘব করবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে এগিয়ে গেছে, তার একটা প্রমাণ মেট্রোরেল। এটি সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায়ও একটি মাইলফলক। অনেকবার বিদেশে দেখেছি, স্বপ্ন ছিলো দেশে কবে হবে। শেখ হাসিনার কল্যাণে আমরা পেলাম।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, আমাদের স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশকে উন্নতি এবং সামনের দিকে নিয়ে যাবেন। তার কন্যা শেখ হাসিনা তা বাস্তবায়ন এবং সফল করায় আমরা আনন্দিত।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, আমার কাছে মনে হলো মাত্রই উঠলাম আবার মাত্রই নামলাম। যেখানে আসতে দুই ঘণ্টা সময় লাগত, সেখানে মনে হলো উঠলাম আর নামলাম। এটা আসলে যে কত বড় উপকার হলো, কোনো ভাষায়ই সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করা যাবে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, এই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়। আমরা সবাই আনন্দিত। বিশেষ করে ঢাকাবাসী। এটা আবেগের সময়, অর্জনের সময়। বিশেষ করে এটি আমরা বিজয়ের মাসে পেয়েছি। এতে আনন্দ আরও বেড়ে গেল।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ঢাকাবাসীর যাতায়াতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে মেট্রোরেল। সাধারণ মানুষ আধুনিক এই রেলের দ্বারা উপকৃত হবে। এটি সরকারের অন্যতম একটি বড় অর্জন।
প্রসঙ্গত, সরকার ২০১২ সালে মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ করে। বাস্তবে কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এই প্রকল্পের উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে রয়েছে-জাপান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা-জাইকা। শুরুতে প্রকল্পের আকার ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। পথ সম্প্রসারণ, স্টেশন প্লাজা নির্মাণ, কিছু স্টেশনে নতুন করে জমি অধিগ্রহণ, পরামর্শকের পেছনে ব্যয় বৃদ্ধি, বাড়তি ভ্যাটের কারণে আরও প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের লাইন-৬ এর খরচ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা দিচ্ছে ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। আর সরকার এই প্রকল্পে খরচ করছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।