ক্ষমতাসীন দল ও মাঠের বিরোধী দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে বাড়ছে উত্তেজনা ও নানা উৎকণ্ঠা

নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে যার যার অবস্থানে অনড় : কর্মসূচি পালটা কর্মসূচি পালন করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার: আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরগরম রাজনীতির মাঠ। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে যার যার অবস্থানে অনড় থেকে কর্মসূচি, পালটা কর্মসূচি পালন করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এরই অংশ হিসাবে ২৮ অক্টোবর একই দিনে রাজধানীতে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে দুদল। কর্মসূচি ঘিরে গত কয়েকদিন ক্ষমতাসীন দল ও মাঠের বিরোধী দলের নেতাদের পালটাপালটি বক্তব্যে বাড়ছে উত্তেজনা ও নানা উৎকণ্ঠা। ক্ষমতাসীনরা বলেছেন, আর ছাড় নয়, আক্রমণ হলে পালটা আক্রমণ হবে। অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য-শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আঘাত এলে তারাও পালটা আঘাত করবে।
আওয়ামী লীগ এবার আটঘাট বেঁধে নেমেছে-এমন মন্তব্য করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, গয়েশ্বর বলেছেন, অনুমতি না দিলে অলিগলি দখল করবে। অলিগলি দখল করলে নাকি সব দরজা খুলে যাবে গয়েশ্বর বাবুকে স্বাগত জানাতে। মনে নাই, আপনি কোরাল মাছের ঝোল খেয়ে আসছেন! এবার আপনার কপাল খারাপ। আমরা আটঘাট বেঁধে নেমেছি। অলিগলিতেও পালাবার পথ পাবেন না। বুধবার বিকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, রাস্তা ছাড়বেন না। আক্রমণ করব না। এ পর্যন্ত করি নাই। তাদের (বিএনপি) ভগবান, অবতার, অনেক শক্তি আছে। অনেকে খবর নেয়। আমরা আক্রমণে ছিলাম না। এইবার সতর্ক পাহারায় আছি। আক্রমণ করলে পালটা-আক্রমণ হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কেন ছাড়ব? অপশক্তিকে রুখতে হবে একসঙ্গে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিএনপির নরম কথায় বিশ্বাস করবেন না। বিএনপির মুখে মধু অন্তরে বিষ। এরা বিশ্বাসঘাতক। এই দলকে বিশ্বাস করা যায় না। বিএনপিকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে নেতাকর্মীদের সতর্ক পাহারায় থাকার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চেতনায়, মননে বাংলাদেশের জনগণ শপথ নিয়েছে। এবারই তাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে হবে।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, আমাদের বিজয়ে বারবার হস্তক্ষেপ করছে। গণতন্ত্রে আঘাত হেনেছে। বিজয় সংহত করতে হলে প্রধানতম শত্রু, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের আসল শক্তি বিএনপিকে পরাজিত করতে হবে। তা না হলে বিজয় সংহত হবে না। তারা বারবার আমাদের বিজয়কে রক্তাক্ত করেছে। তিনি আরও বলেন, একদিন-দুদিনের জন্য নয়, তাদের সম্পূর্ণরূপে মোকাবিলা করে সুসংহত বিজয় চাই। দুর্নীতিবাজ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অস্তিত্ব বাংলার মাটি থেকে মুছে ফেলতে হবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে এবং ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পনিরুজ্জামান তরুণের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন দলের আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য-ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- মাহবুবউল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ প্রমুখ।
সভায় আগামী ২৮ অক্টোবর বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে দুর্বৃত্ত-সন্ত্রাসীরা ঢুকে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছে অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন, শহরের বিভিন্ন হোটেল-ফ্ল্যাট বাসা-বাড়িতে দ্বিগুণ টাকায় ভাড়া দিয়ে তারা আস্তানা বানিয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা দেশে একটি অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তাই সবাইকে পাড়া-মহল্লায় পাহারা থাকতে হবে। কেউ যাতে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে নানক বলেন, কোনো অরাজকতা হলে দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে।
মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, সমাবেশের পর বিএনপি যদি কোনো নৈরাজ্য করতে চায়, তাহলে তাদের সমুচিত জবাব দেয়া হবে। আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যদি রাজপথে নামে তবে বিএনপি-জামায়াতের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তাই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে বাড়ি ফিরে যান।
মির্জা আজম বলেন, আগামী ২৮ অক্টোবরের শান্তি সমাবেশে ব্যানার না আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপরও যারা ব্যানার নিয়ে সমাবেশে হাজির হবে তাদের দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। ২৮ অক্টোবর বেলা ১২টায় শুরু হবে সমাবেশ এবং প্রধান অতিথি বক্তব্য না দেওয়া পর্যন্ত চলবে। নেতাকর্মীরা সেই পর্যন্ত সমাবেশস্থলে অবস্থান করবে।
মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ২৮ তারিখ আমি আপনাদের সঙ্গে রাজপথে থাকব। আমরা কোনো কিছু কেড়ে নিতে দেব না। ২৮ অক্টোবর যেমন আমরা লগি-বৈঠা নিয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিলাম, ঠিক তেমনি আবারও এই ২৮ তারিখ আমরা গণতন্ত্রকে রক্ষা করব।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে শেখ বজলুর রহমান বলেন, ২৮ তারিখে নৌকার পেছনে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে যেতে হবে। ফেস্টুনে মোটা মোটা লাঠি থাকবে। আমাদের কর্মীরা সব জানে বিএনপির লোকজন কোথায় থাকে, কোন মেসে থাকে, কোন হোটেলে থাকে, সব জানা আছে আমাদের।
আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনেই মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘সোজা কথা, আমরা সমাবেশ করব। যেখানে (নয়াপল্টনে) করার কথা, সেখানে করব। সেটা পুলিশের অনুমতি নিয়ে করতে হবে, সংবিধানের কোথায় আছে? নয়াপল্টনে করতে না দিলে পুরো ঢাকার অলিগলিতে নেতাকর্মীরা ছড়িয়ে পড়বে। যার যা আছে তা নিয়ে। দেখবেন প্রত্যেক মানুষ ঘরের দরজা খুলে দিয়ে রাস্তায় নেমে আসবে। এখন টের পাচ্ছেন না, তখন টের পাবেন।’
বুধবার দুপুরে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। জনতার অধিকার পার্টির (পিআরপি) উদ্যোগে ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একদফা দাবিতে’ এ সভা হয়। বিএনপির মহাসমাবেশের স্থান নিয়ে বিতর্কে না জড়াতে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিটি কর্মসূচি গণতান্ত্রিকভাবে করছি, গণতান্ত্রিকভাবেই করব। আর পুলিশ প্রশাসনের লোক কিছু বাড়তি বাড়তি কথাবার্তা বলেন। তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলব, রাজনৈতিক বিতর্ক রাজনীতিবিদদের মধ্যে থাকতে দিন। রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে আপনারা জড়াবেন না।’
গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, ‘আমরা কোথায় সমাবেশ করব, করতে পারব না, আপনারা রাজনৈতিক বিবেচনায় যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেন, সেই সিদ্ধান্ত আমরা যে মানতে বাধ্য, তা তো নয়। আমি কোথায় মিটিং করব, কোথায় করতে পারব না, সেটা পুলিশের অনুমতি নিয়ে করতে হবে, সংবিধানের কোথায় আছে?’ জনতার অধিকার পার্টির চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য দেন-ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাগপার একাংশের সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর প্রমুখ।
মহাসমাবেশ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্যের সমালোচনা রিজভীর: বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, মহাসমাবেশ নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই হবে।
মহাসমাবেশ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে রিজভী বলেন, ‘মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘যেখানেই অনুমতি দেওয়া হবে সেখানেই বিএনপিকে সমাবেশ করতে হবে।’ পুলিশ কর্মকর্তাদের এ রকমের বক্তব্যে এটাই প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের জনগণ এখন পরাধীন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের কর্মকা-, মতপ্রকাশ ইত্যাদি সবকিছুই এখন পুলিশের ছাড়পত্রের ওপর নির্ভর করবে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপিসহ বিরোধী দলের প্রতি অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশের ক্রোধ একই রকমভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। তারা মনে করে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আক্ষরিক অর্থেই শেখ হাসিনার লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে কাজ করছে। অবৈধ সরকারের মন্ত্রীদের সুরে সুর মিলিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের হুমকির মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আওয়ামী মন্ত্রী ও নেতাদের হত্যার হুমকি, নির্মূলের হুমকি, হেফাজতকে দমনের মতো করে বিএনপির সমাবেশ নিয়ে হুমকি এক উপসংহারহীন পরিণতির সৃষ্টিরই ইঙ্গিত করা হচ্ছে। বিষয়টি এমন দাঁড়াচ্ছে যে, আইন-আদালতের ভবন আছে, কিন্তু বাস্তবে বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘শেখ হাসিনাই হলো আইন।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘পুলিশ কর্মকর্তারা তো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তারা তো মালিক নন। তারা কীভাবে নির্ধারণ করে দেয় রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ কোথায় হবে? বিএনপি একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল, যাদের কয়েকবার দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই দলটি কি জানে না যে, সমাবেশ কোথায় করতে হয়? পুলিশ কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্য রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে বাধাদান ও সরাসরি হস্তক্ষেপ।’
রিজভী আরও বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে নিয়ে ঢাকা মহানগরকে ভয়ংকর আতঙ্কের জায়গা বানাতে চাচ্ছে সরকার। রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে র‌্যাবের চৌকি বসিয়ে তল্লাশির নামে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বাড়িসহ আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ ও সাদা পোশাকধারী পুলিশ তল্লাশির নামে গ্রেফতার ও নানা কায়দায় হয়রানিসহ পরিবারের সদস্যদেরও বিভিন্নভাবে নাজেহাল করছে।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম, নির্বাহী কমিটির সদস্য ফজলুর রহমান খোকন প্রমুখ।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More