ক্রমেই উত্তপ্ত রাজপথ : রাজনৈতিক সংঘাতে জনমনে উদ্বেগ

বিএনপির আন্দোলন শুরুতেই থামিয়ে দিতে চায় ক্ষমতাসীন দল

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখোমুখি অবস্থানে রাজপথ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। গত কয়েকদিন ধরে দেশের কোথাও না কোথাও দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি পুলিশ খুলনা, পটুয়াখালী ও রাজবাড়ীতে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়তে বাধ্য হয়েছে। ত্রিমুখী সংঘাত-সংঘর্ষে বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই পক্ষই রাজপথ দখলে রাখার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে। এতে আগামী দিনগুলোতে রাজপথের উত্তাপ কতোটা ভয়াবহ রূপ নেবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নেতাকর্মীদের অহেতুক হয়রানি-নির্যাতন ও রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার বন্ধসহ কয়েকটি ইস্যুতে টানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি বেগবান করারও প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলটি। এদিকে বিএনপির আন্দোলন ঠেকাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কৌশলী পথ খুঁজছে। পাশাপাশি বিকল্প পথও তারা তৈরি করে রাখছে। সরকারি দলের নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, বিএনপি যেভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে, এটি অব্যাহত থাকলে দলটির কর্মীরা নিজেদের শক্তিশালী ভাবতে শুরু করবে। তারা বাধা উপেক্ষা করে পাল্টা হামলায়ও জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই বিএনপির আন্দোলন শুরুতেই থামিয়ে দিতে চায় ক্ষমতাসীন দল। এর কৌশল হিসেবে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে থাকা পুরানো মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি নতুন মামলায় গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে বিএনপির আন্দোলন থামিয়ে দিতে চাচ্ছে। তবে বিএনপিও এসব প্রতিবন্ধকতা মাথায় নিয়েই আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে যাচ্ছে। অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যেতে মাঠের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার প্রাণবন্ত চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে দু’পক্ষ এখন ক্রমেই মুখোমুখি হয়ে পড়ছে। সঙ্কট নিরসনে দুই দলের আলোচনা বা সংলাপের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং দিন যতই গড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে সংঘাত ততোই বাড়ছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশ ভীষণভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর কে এম মহিউদ্দিন বলেন, দেশের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ালে স্বাভাবিকভাবেই জনমনে অসন্তোষ ও উদ্বেগ দেখা দেয়। পাশাপাশি অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু এখনো হরতাল-অবরোধের মতো কোনো বড় কর্মসূচি না আসায় অর্থনীতিতে সেই প্রভাব এখনো অনুপস্থিত। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলমান রয়েছে, তাতে সে দুঃসময় বেশি দূরে নয় বলে মনে করেন তিনি। এদিকে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে দেশের অর্থনীতিবিদরা জোরালো আশঙ্কা করছেন। তাদের ভাষ্য, করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ফের তাতে মন্দা হাওয়া লেগেছে। বৈশ্বিক প্রভাবে খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে। এতে দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশাল জনগোষ্ঠীর নাভিশ্বাস উঠেছে। এ দুঃসময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় সাধারণ জীবনযাত্রায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠবে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ-শোডাউন ও সংঘাত-সহিংসতায় সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যস্ত সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এতে কর্মজীবী মানুষ সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছুতে ব্যর্থ হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন উপার্জন কমছে। উত্তপ্ত আন্দোলন কর্মসূচিতে পণ্য পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানামুখী সঙ্কটে জিনিসপত্রের দাম আরও এক ধাপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের উদ্বেগের পারদ ক্রমেই চড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অপরাধ পর্যবেক্ষকরা জানান, রাজনৈতিক সংঘাতে শুধু নেতাকর্মীরাই নয়, বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষও হতাহত হচ্ছেন। নিরীহ মানুষের যানবাহন-দোকানপাটসহ বিভিন্ন সম্পত্তি বিনষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে পড়ে পুলিশও রাজনৈতিক ক্যাডারদের হামলার শিকার হচ্ছেন। অথচ আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে না এসে রাজপথে আরও সোচ্চার হওয়ার হুংকার দিচ্ছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, বৈশ্বিক সঙ্কটের এই দুঃসময়ে রাজপথে উত্তাপ বাড়লে সংঘাতের সীমানা দ্রুত বিস্তৃত হবে। সমাজের নানা স্তরে খুনোখুনি ও লুটপাটসহ নানা অপরাধ বাড়বে। রাজনীতির সঙ্গে যাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, তারাও নির্বিচারে এসব অপতৎপরতার শিকার হবে। আইনের শাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ভেঙে পড়ারও শঙ্কা রয়েছে। এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘বর্তমান সরকারের সময় শেষ’ বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী আজকে এই অবস্থায় যতোই চিল্লা-চিল্লি করেন, যতোই জাপান, যুক্তরাজ্য, আমেরিকার আর সৌদি আরব, কাতার, চীনে যান-কোনো লাভ হবে না। সময় শেষ। এটাই বাস্তবতা। তিনি নেতাকর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা অনেক কষ্ট করেছেন, আর কিছু কষ্ট করতে হবে। এই সরকারকে টেনে না নামালে এরা যাবে না। সেজন্য আমাদেরকে সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, ব্যক্তি-সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আমাদের জীবনকে বাজি রেখে এই দেশকে মুক্ত করবার জন্য, এই দেশের মানুষকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য-আমাদের যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে। এর আগে মির্জা ফখরুল এ সরকারকে না হটিয়ে ঘরে ফিরবেন না বলে হুশিয়ারি দেন। বিএনপির এসব হুমকি-ধামকির পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আর নাকি ঘরে ফিরবে না। আমরাও দেখবো কই থাকে। ফখরুল উত্তরায় থাকতো, এখন গুলশানে এসে গেছে। সব এক সঙ্গে লড়াই করবে! লাভ নাই। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। যে আগুন হাতে নিয়েছেন, এই আগুনে আপনাদের হাত পুড়িয়ে দেব।’ এর আগে বিএনপিকে হাটুভাঙ্গা দল বলে আখ্যায়িত করে দলটির আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। অন্যদিকে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগ ও সরকারকে হুঁশিয়ার করে জানান, দেশজুড়ে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা, মামলা, গ্রেফতার ও সংঘর্ষের মতো ঘটনা বাড়তে থাকলেও তারা এবার রাজপথ ছাড়ছে না। বরং নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণে তারা আরও সোচ্চার হবে। হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা যতোই ঘটুক, তারা মাঠে থেকেই তা মোকাবিলা করবে। এর মাধ্যমে তারা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তবেই ঘরে ফিরবে। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলি ও ক্ষমতাসীনদের হামলায় বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী আহত হওয়ার পর তারা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখান থেকে সরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। বরং আন্দোলন আরও বেগবান করা হবে। এদিকে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থান ও পাল্টাপাল্টি হুংকারে অর্থনীতিবিদরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এটি দেশের জন্য অশনি সংকেত। শুধু রাষ্ট্র পরিচালনাই নয়, ব্যক্তি থেকে শুরু একটি দেশের প্রায় প্রতিটি বিষয়ে রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থাকে। তবে অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্রটা অন্যসব উপাদানের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে রাজনীতির আকাশে মেঘ থাকলে তা অর্থনীতিকেও মেঘাচ্ছন্ন করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এবং পরে দীর্ঘদিন ধরে সরকার বিরোধী হরতাল-অবরোধের আন্দোলনে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার বিরোধীদের টানা সহিংস আন্দোলনে মুখ থুবড়ে পড়েছিলো দেশের অর্থনীতি। বৈদেশিক বিনিয়োগ না আসা ও রপ্তানিতে ধস নামাসহ অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাবের কারণে দেশে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ ছিলো ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। তবে গত কয়েকদিন ধরে রাজপথে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে লড়াই চলছে তা অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। যা পরবর্তীতে সামাল দেয়া কঠিন হবে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অনেকাংশে কমে যায়। কারণ এতে বিনিয়োগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগ করতে ভয় পায়। তারা তখন বিদেশে টাকা পাচার করতে উৎসাহী হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্ল্যাহ বলেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশে সভা-সমাবেশ করতে পারা বিরোধী দলগুলোর অধিকার। অথচ মাঠপর্যায়ে বিরোধীদের কর্মসূচিতে অনেক ক্ষেত্রে হামলা করা হচ্ছে। এর ফলে পরমতসহিষ্ণু রাজনীতির যে সুযোগ, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় কি না, সেই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করেন, বিরোধী দলগুলো অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করছে। মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ তৈরি করা, গণসংযোগ করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সভা-সমাবেশ। এই সুযোগটা তাদের দেয়া উচিত। আর যদি এভাবে বিরোধীদের ওপর হামলা চলতে থাকে, এরপরও যদি তারা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে মানুষের সহানুভূতি আরও বেড়ে যাবে। যদি চাপে বিরোধীরা রণে ভঙ্গে দেয়, তাহলে মানুষের আস্থার জায়গা সঙ্কুচিত হবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা, তাতে এখন সহিষ্ণুতার খুব প্রয়োজন। এর জন্য সরকারের সদিচ্ছা খুবই দরকার। এর ব্যত্যয় দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশঙ্কাজনক।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More