কৃত্রিম সঙ্কটে তেলের বাজার অস্থির : মিল মালিকদের কারসাজি
রিফাইনারি বেধে দেয়া দামের চেয়ে বোতলের গায়ে বেশি লিখে বাজারজাত
স্টাফ রিপোর্টার:
ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিরতার নেপথ্যে মিল মালিকদের কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কোম্পানিগুলো ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ইস্যুর পর নির্দিষ্ট সময়ে সরবরাহ করেনি এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। ম‚ল্য কারসাজির সঙ্গে জড়িত একাধিক পাইকারের সন্ধানও মিলেছে। ডিও নিয়ে তারা নির্দিষ্ট সময়ে ভোজ্যতেল গ্রহণ করেনি। বেশি মুনাফার আশায় তেল ধরে রেখেছে। এতে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সরবরাহ চেইনে। মিলগুলোর আমদানি, মজুত ও সরবরাহ তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রমাণ মিলছে। শিগগিরই এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। সংশ্লিষ্ট স‚ত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
প্রসঙ্গত এর আগে ভোজ্যতেল সব রিফাইনারদের কাছে তথ্য চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাইকারদের কাছে কী পরিমাণ তেলের ডিও বা এসও ইস্যু করেছে, তেল সরবরাহের পরিমাণ ও মজুত আছে তা জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া গত তিন মাসে তাদের আমদানির পরিমাণ, কত পরিমাণ তেল পরিশোধন করা হয়েছে কাস্টমস পেপারসহ এ সব কিছু তথ্য চাওয়া হয়। গত ৭ মার্চের মধ্যে এসব তথ্য দাখিলের জন্য কোম্পানিগুলোকে সময় বেধে দেয়া হয়। সেগুলো এরই মধ্যে হাতে পেয়েছে মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, রিফাইনারিগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে গোড়ায় গলদ রয়েছে। বাজার অস্থিরতার কার্যক্রম সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। প্রত্যেক স্তরে অনিয়ম করা হয়েছে। পাইকাররাও জড়িত আছে। এ বিষয়ে শিগগিরই রিপোর্ট মিডিয়ার কাছে তুলে ধরা হবে।
স‚ত্র জানায়, নানা ধরনের কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ে রিফাইনারিগুলো। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সংকটের গুজবে বাজারে যখন ভোজ্যতেলের ম‚ল্যবৃদ্ধি তুঙ্গে, এক লিটারের বোতল উধাও ঠিক ওই সময় মেশিনারিজ মেরামতের নামে একটি রিফাইনারি তাদের উৎপাদন বন্ধ রাখে। এটি নজর কেড়েছে মন্ত্রণালয়ের। কারণ এই সময়ে বন্ধ রাখার কথা নয়। ক্রান্তিকালে এই বন্ধ রাখা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। এটি নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।
এছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার যেখানে ভোজ্যতেলের ম‚ল্য বেধে দিয়েছে এবং রিফাইনারিদের ম‚ল্য বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়। কিন্তু একাধিক রিফাইনারি বেধে দেয়া দামের চেয়ে বোতলের গায়ে বেশি লিখে বাজারজাত করেছে। মিলগুলো থেকে দাম বাড়িয়ে বাজারজাত করায় এমনিতেই ব্যর্থ হয়েছে সরকারের ম‚ল্য বেধে দেয়ার কার্যক্রম। এটি করেছে একটি রিফাইনারি কোম্পানি।
স‚ত্র আরও জানায়, ভোজ্যতেলের ডিও এবং এসও নিয়ে এক ধরনের কৌশল ধরা পড়েছে। ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) পাইকারদের জন্য ইস্যু করা হয় মিল থেকে। কিন্তু কত টাকা ম‚ল্যে তেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে সেখানে ফাঁকা রাখা হয়। অর্থাৎ বেশি দামে বিক্রি করে নজর এড়াতে এ কৌশল নেয়া হয়। ফলে পাইকাররাও বাজারেও ইচ্ছেমতো দাম আদায় করে খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে। আর খুচরা বিক্রেতা ইচ্ছেমতো বিক্রি করেছে ভোক্তার কাছে।
এছাড়া এসও (সাপ্লাই অর্ডার) নিয়ে কারসাজি হয়েছে। এ কারসাজি মিলার ও পাইকার উভয় দিক থেকে করা হয়েছে। একটি এসও ইস্যুর পর পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার নির্দিষ্ট দিন তারিখ সেখানে উল্লেখ্য থাকে। পাইকারকে ওই তারিখের মধ্যে ডেলিভারি বুঝে নিতে হয় মিল থেকে। কিন্তু দেখা গেছে, এসও নিয়ে কোনো কোনো পাইকার বেশি দামে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এভাবে একাধিকবার এসও হাত বদল হয়ে ম‚ল্য বেড়েছে কিন্তু পণ্য বাজারে আসেনি। আবার সরবরাহ চেইনে মিলমালিকরা ডেলিভারি দিচ্ছে বিলম্বে। এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। এসব কারণে বাজারে ভোজ্যতেলের ম‚ল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তবে রিফাইনারি ও পাইকার উভয়ে এই ম‚ল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দুষছেন আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিকে।
জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে যে তথ্য মিল মালিকরা দিয়েছেন সেখানে দেখা গেছে ভোজ্যতেলের মজুত পর্যাপ্ত আছে। দেশের মোট ৭টি মিলে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের মজুত আছে ১৯ হাজার ৭৩৭ টন। আর অপরিশোধিত ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৯ টন। এই দুই পর্যায়ে মোট ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬০৬ টন ভোজ্যতেল মজুতের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থায় কমপক্ষে ১০ শতাংশ তেল এমনিতেই মজুত থাকে। এ হিসাবে প্রায় ৮০ হাজার টন তেল বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা দোকানে আছে। সব মিলে সরবরাহ ও মজুতের পরিমাণ ২ লাখ ৭৬ হাজার টন। পাশাপাশি মিলগুলো তেলের এলসি খুলেছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৮০০ টন। যা দেশে আসার জন্য পাইপলাইনে আছে। বিপরীতে এখন থেকে আসন্ন রমজানের সময়ে দেশে ২ লাখ ৬৭ হাজার টন তেলের দরকার হবে। এই চাহিদার চেয়ে এখনো ৯ হাজার টন বেশি আছে। পাশাপাশি আমদানি প্রক্রিয়ায় আছে আরও ২ লাখ ৭২ হাজার টন। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে। এটি মূলত পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ভোজ্যতেল রিফাইনারিদের ওপর অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। জানতে চাইলে কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, ভোজ্যতেল মিলগুলোর আমদানি, ওয়ারহাউজে মজুতের পরিমাণ ও বন্দরে খালাসের অপেক্ষমাণ তেলের হিসাব নিয়ে কাজ করছে অনুসন্ধান টিম। এছাড়া এই সময়ে মিলগেট থেকে কী পরিমাণ ভোজ্যতেল ছাড় করা হয়েছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবৈধ মজুত, বাজার কারসাজি ও সিন্ডিকেট করা হয়েছে কিনা বের করে আনা হবে। যদি তাদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ হয় বাজারে প্রতিযোগিতা নষ্ট করেছে, সেক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।