করোনায় দেশে প্রথম শতাধিক লোকের মৃত্যু : শিগিগরই নিয়ন্ত্রণে আসবে না মৃত্যু ও সংক্রমণের হার

স্টাফ রিপোর্টার: করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর এক বছরের বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো শতাধিক মৃত্যু দে দেখলো দেশ। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে ১০ হাজার ১৮২ জন মারা গেলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু শিগিগরই ঠেকানো যাবে না। করোনার দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়তেই থাকবে। দক্ষিণ অফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট খুবই শক্তিশালী। এই ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত রোগীকে কাবু করে ফেলছে। রোগীরা সর্দি, কাশি ও জ্বরকে অবহেলা করে বিলম্বে এমন সময় হাসপাতালে যাচ্ছেন, যখন তাকে আইসিইউতে নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে। আর আইসিইউ তো দূরের কথা সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে সাধারণ শয্যাই খালি নেই। বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাদের অনেকের মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। আর আক্রান্ত বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে। এছাড়া করোনা ভাইরাসটি দেশে কত দিন থাকবে তা কেউ বলতে পারে না। এ ব্যাপারে সবাই অনুমানভিত্তিক কথা বলছেন। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমে নিজেকে নিজেরই রক্ষা করতে হবে। সংক্রমণ ঠেকাতে আরো এক সপ্তাহ লকডাউন দেয়ার দাবি জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এখনো সময় আছে সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে আসুন। চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
এদিকে দেশে ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকায় রোগীদের চিকিৎসাসেবা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে আগামীকাল রবিবার ২১২ বেডের অত্যাধুনিক করোনা আইসিইউ উদ্বোধন করা হবে। মহাখালীর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মার্কেটেই হচ্ছে এই হাসপাতাল। একই সঙ্গে এই হাসপাতালে ৫০ শয্যার মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি বেড চালু করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১ হাজার সাধারণ শয্যাও চলতি মাসের মধ্যে চালু হবে। নতুন এই করোনা হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, ২১২ বেডের করোনা আইসিইউ ১৮ এপ্রিল উদ্বোধন করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চালু হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, বর্তমানে দেশে করোনা পরিস্থিতি জটিল। সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে যা যা করার তা-ই করতে হবে। করোনার কোনো উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, করোনায় মৃত্যুর মিছিল শিগিগরই থামবে না। মৃত্যু আরো বাড়বে। আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, করোনার আগের ভ্যারিয়েন্ট দুর্বল ছিলো। কিন্তু বর্তমান ভ্যারিয়েন্ট শক্তিশালী। বিলম্বে চিকিৎসাসেবা নিলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, করোনায় মৃত্যু কমতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগতে পারে। আইসিইউতে যাতে যেতে না হয় সেজন্য সবার সতর্ক থাকতে হবে। শুরুতে সময়মতো চিকিত্সা না নেওয়ার কারণে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। আরো এক সপ্তাহ লকডাউন দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, করোনা থেকে রক্ষা পেতে হলে সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, কোনো হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য সিট খালি নেই। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এভাবে বাড়তে থাকলে সামনে চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হবে না। আর মানুষ সচেতন না হলে মৃত্যু ও সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব না। আরো এক সপ্তাহ লকডাউন দেয়া উচিত।
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. আনোয়ার হোসেন খান বলেন, তার হাসপাতালে ৩০টি আইসিইউ বেড ও ১৫টি এসডিও বেড রয়েছে। সবগুলোতে রোগী ভর্তি আছে। সাধারণ শয্যাও খালি নেই। তিনি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন। প্রসঙ্গত, করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতে গিয়ে তিনি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
এদিকে এক দিনে ১০১ মৃত্যুর আগের দুদিন দৈনিক মৃত্যু ৯০-এর বেশি ছিলো। বৃহস্পতিবার ৯৪ জন এবং বুধবার ৯৬ জন মারা যান। গত ৩১ মার্চ ৫২ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর থেকে দৈনিক মৃত্যু কখনোই ৫০-এর নিচে নামেনি। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪ হাজার ৪১৭ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ১১ হাজার ৭৭৯ জনে দাঁড়ালো। গত এক দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৬৭ জন পুরুষ আর নারী ৩৪ জন। তাদের মধ্যে সাত জন বাড়িতে, বাকিদের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। মৃতদের মধ্যে ৬৩ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ২৩ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছর, আট জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর এবং সাত জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল। মৃতদের মধ্যে ৫৯ জন ঢাকা বিভাগের, ২০ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, তিন জন রাজশাহী বিভাগের, পাঁচ জন খুলনা বিভাগের, চার জন বরিশাল বিভাগের, এক জন সিলেট বিভাগের, ছয় জন রংপুর বিভাগের এবং তিন জন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। দেশে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ১০ হাজার ১৮২ জনের মধ্যে ৭ হাজার ৫৬৬ জনই পুরুষ এবং ২ হাজার ৬১৬ জন নারী।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More