এসএসসি ও সমমান ফল প্রকাশ : স্বপ্নজয়ের উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা
দেশের ৫০ প্রতিষ্ঠানের সবাই ফেল : আজ থেকে ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন
স্টাফ রিপোর্টার: চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল গতকাল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার ৮৮ দশমিক ১০। আর মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার কমলেও বেড়েছে জিপিএ ৫’র সংখ্যা। ফলাফলে এবারও ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে। চলতি বছরে ৫০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করতে পারেনি। সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিস্তারিত এসব তথ্য তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এর আগে দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফলাফলের কপি হস্তান্তর করা হয়।
এ বছর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন অংশগ্রহণ করেছে। এতে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন। জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। অন্যদিকে গত বছর পাসের হার ছিলো ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছিলো এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। গতবছর পরীক্ষার্থী ছিলো ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ জন। এবছর মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে শুধু সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীন এসএসসি পরীক্ষার্থী ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫৭ জন।
এগিয়ে যশোর বোর্ড, পিছিয়ে সিলেট: ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় এবার পাসের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে গড় পাসের হার ৯৫ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা ৯টি বোর্ডের গড় পাসের হারের চেয়ে ৭ শতাংশের বেশি। আর পাসের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। এবার সিলেটসহ কয়েকটি এলাকায় ভয়াবহ বন্যার কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন গড় পাসের হার ৮৮ দশমিক ১০ শতাংশ। শুধু এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৩ জন। এবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৯০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ, কুমিল্লায় পাসের হার ৯১ দশমিক ২৮ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার ৮৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৮৯ দশমিক ৬১ শতাংশ, ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ। এছাড়া মাদরাসা বোর্ডের পাসের হার ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডের হার ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
এবারও এগিয়ে ছাত্রীরা: কয়েক বছর ধরেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে ভালো করছে ছাত্রীরা। গতবারের মতো এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়ও পাসের হার ও ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ ৫ পাওয়ার দিক দিয়ে ছাত্রদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে ছাত্রীরা। এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড এবং মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ডে গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ছাত্রীদের গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর ছাত্রদের গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এর মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৬ জন। ছাত্রসংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ১৫৬ জন। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী কম ছিলো। এবার ছাত্রী ছিল ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন, ছাত্র ছিলো ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৩ জন। আলাদাভাবে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন শুধু এসএসসি পরীক্ষায়ও এগিয়ে আছে ছাত্রীরা। এসএসসিতে ছাত্রীদের পাসের হার ৮৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। ছাত্রদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর এসএসসিতে মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী এক লাখ ৩১ হাজার ৩০৪ জন, ছাত্র এক লাখ ২ হাজার ৪৫৯ জন। গত বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ছাত্রীদের পাসের হার ছিলো ৯৪ দশমিক ৫০। ছাত্রদের পাসের হার ছিলো ৯২ দশমিক ৬৯। সে বছর মোট জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ছিলো এক লাখ ৩ হাজার ৫৭৮ জন। ছাত্র ছিলো ৭৯ হাজার ৭৬২ জন।
৫০ প্রতিষ্ঠানের সবাই ফেল: চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় শূন্য পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। এবার মোট ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। গত বছর এই সংখ্যা ছিলো ১৮। এদিকে শতভাগ পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। এবার মোট ২ হাজার ৯৭৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী পাস করেছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতি ও বন্যার কারণে দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সাধারণত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে বয়সের বাধা থাকবে না: শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, কারিগরি শিক্ষার দ্বার আমরা সবার জন্য উন্মুক্ত করছি। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়সের বাধা আমরা তুলে দিতে চাই। আশাকরি, সবাই এ বিষয়ে সহযোগিতা করবেন। দ্রুততার সঙ্গে এটি করতে পারলে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে আর কোনো বয়সের বাধা থাকবে না। এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে একথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তিতে আসন সংকট হবে না। মাধ্যমিকে যে পরিমাণ পাস করে তার চেয়ে আমাদের আসন সংখ্যা বেশি রয়েছে। তাই মাধ্যমিকে পাস করা সব শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পরও আসন খালি থাকবে। তিনি বলেন, আগামী বছর থেকে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়েছে। আগামীতেও ক্রমাগতভাবে এসব প্রশিক্ষণ চলবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অতিমারির মধ্যে অনলাইন শিক্ষায় আমরা এগিয়ে গিয়েছি। সফলভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ করানো সম্ভব হয়েছে। সব শিক্ষককে সরাসরি ও অনলাইনভিত্তিক নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া অব্যাহত থাকবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ডা. দীপু মনি বলেন, বর্তমানে পাঠ্যপুস্তক তৈরিতে কাগজের সংকট দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিকভাবে এ সংকট রয়েছে। এখন কাগজের দাম বেড়েছে। কিছুটা সংকট আমাদেরও তৈরি হয়েছে। এটি নিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় হবে না। আমরা আশাকরি, যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পারবো। তিনি বলেন, বিজ্ঞান নিয়ে কিছু শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি কাজ করে বলে মানবিক বিভাগে শিক্ষার্থী বেশি হয়। অঙ্ক পারি না, বিজ্ঞান বুঝি নাÑএমন ধারণা অনেকের থাকে। আমাদের উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শিক্ষকের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নতুন কারিকুলামে পড়ে-বুঝেই পরের ক্লাসে যেতে হবে। কেউ পারবে না বলে শিক্ষক তাকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়া থেকে বঞ্চিত করবে সে পরিস্থিতি থাকছে না। আমরা মনে করি শিক্ষার্থী বিজ্ঞানে যেতে চাইলে তাকে পড়তে দেয়া উচিত। যদি সেখানে সে ভালো করতে না পারে তবে বিভাগ বদলাতে পারে। এখন বিজ্ঞানে পড়তে হবে। মানবিকে পড়লে যে আমি তথ্যপ্রযুক্তি বা বিজ্ঞানে যেতে পারবো না এখন আর সেটি নেই। মানবিকে পড়ে অনেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে ভালো করছে। যে কোনো বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা করার সুযোগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য বেশি জরুরি হচ্ছে সফট স্কিল, এন্টারপ্রিনিয়রশিপ (উদ্যোক্তা) স্কিল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সব বিভাগের কোর্সের মধ্যে ভাষা শিক্ষা, আইসিটি, সফট স্কিল, উদ্যোক্তা ও নৈতিকতা যুক্ত করতে বলা হয়েছে। প্রত্যেকে এ বিষয়গুলো বুঝে সনদ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবে। যে কোনো বিভাগ থেকে এসব দক্ষতা নিয়ে বের হলে যে কোনো কাজেই সফল হওয়া সম্ভব হবে।
ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন আজ থেকে: ২০২২ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট না হওয়া শিক্ষার্থীরা প্রতিবারের মতো এবারও পুনঃনিরীক্ষার আবেদনের সুযোগ পাবে। এবার ফল পুনঃনিরীক্ষণের জন্য ২৯ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ আবেদন করতে পারবে শিক্ষার্থীরা। গতকাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. আবুল বাশার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে জানানো হয়, প্রতিটি বিষয় ও প্রতি পত্রের জন্য ১২৫ টাকা হারে চার্জ কাটা হবে। যেসব বিষয়ের দুটি পত্র (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) রয়েছে, সেসব বিষয়ের ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করলে মোট ২৫০ টাকা ফি কাটা হবে।