এপিজি থেকে আপত্তির শঙ্কা : পাচারের টাকা দেশে ফেরানো কঠিন

প্রচলিত আইনি কাঠামোতে বিশেষ ছাড়ের উদ্যোগ : এ সুবিধা কার্যকরে আইনি জটিলতা অনেক

স্টাফ রিপোর্টার: বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবেলায় পাচার করা টাকা দেশে ফেরাতে প্রচলিত আইনি কাঠামোতে বিশেষ ছাড় দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী অর্থ বছরের বাজেটেই এ বিষয়ে ঘোষণা দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু পাচারকারীদের ওই সুবিধা দিতে হলে সংবিধানসহ বেশ কিছু আইন লঙ্ঘনের শঙ্কা আছে। এছাড়া বিশ্বের সামনে দেশের ভাবমূর্তি বিশেষ করে এপিজের আপত্তির মুখ পড়ার ভয়ও আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে-ওই সুযোগ দিতে হলে পাচারকারীদের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, আয়কর অধ্যাদেশ ও দুর্নীতি দমন আইনের কিছু ধারা থেকেও অব্যাহতি দিতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) থেকেও আপত্তি উঠতে পারে। তবে সরকার এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে।

সূত্র জানায়, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনলে ৭ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তা আয়কর রিটার্নে দেখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে ওই অর্থ নিয়ে সরকারের কোনো সংস্থা এ বিষয়ে প্রশ্ন করবে না। এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েই এ ব্যাপারে কাজ হচ্ছে। তবে বাজেটের আগে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হলে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা থেকে পাচারকারীদের অব্যাহতি দিয়ে আইন বাস্তবায়নকারী মূল কর্তৃপক্ষকে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। এছাড়াও বাজেটের অর্থবিল আইনের মাধ্যমেও পাচারকারীদের অব্যাহতি দিয়ে এটা করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে ৯ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কেননা ওই দিন বাজেট পেশ হবে। এর সঙ্গে অর্থবিলও উপস্থাপন করা হবে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাজেটের আগেই সরকার এটি করতে চায়। সেক্ষত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। এছাড়া কোনোভাবেই দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। ওই সুযোগ দিলে একদিকে র্দুীতি উৎসাহিত করা হবে। অন্যদিকে নাগরিকের সমান অধিকার ক্ষুণœ হবে। এতেই সংবিধান লঙ্ঘন হবে। কেননা, দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে এটাই সংবিধানের নীতি। কিন্তু তা না করে বিশেষ ছাড় দিয়ে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করলে আইনের সমান প্রয়োগ হবে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের সুযোগ কোনো ক্রমেই দেওয়া ঠিক হবে না। দিলে বহুবিধ আইনের লঙ্ঘন হবে। দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে। আর দিলেও টাকা ফেরত আসবে বলে মনে হয় না। ডলার সংকট মোকাবেলায় এ সুযোগ দেওয়ার কারণ নেই। ডলার সংকট মোকাবেলা করতে সরকারের দুটি পদক্ষেপই যথেষ্ট। এক. টাকা পাচার বন্ধ করা এবং দুই. রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে হুন্ডি বন্ধ করা। এ দুটি করলে জাদুকরী ফল মিলবে। এগুলো করা কঠিন কিছু নয়।

সূত্র জানায়, বাজেটের আগে ওই সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ও নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, দেশ থেকে সীমার অধিক বৈদেশিক মুদ্রা নিতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগাম অনুমোদন নিতে হয়। রপ্তানির বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা যথাসময়ে না এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হয়। দেশ থেকে পুঁজি নিয়ে বিনিয়োগ করতে বা কোনো সম্পদ গড়ে তুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু অনুমোদন ছাড়া কেউ যদি দেশ থেকে সম্পদ পাচার করে থাকেন বা রপ্তানি আয় বিদেশে রেখে দেন তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রচলিত আইনি কাঠামোয় ওইসব সম্পদ বিদেশ থেকে দেশে আনার সুযোগ নেই।

এদিকে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় পাচার করা অর্থ দেশে এনে বর্তমান সংকট মেটানোর ব্যবস্থা করতে চায় সরকার। অন্য একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার করে অনেকে বিপাকে পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট দেশের আয়কর ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কর্তৃপক্ষের কাছে এত অর্থসম্পদ কিভাবে অর্জন করেছেন তার বৈধ কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। এসব কারণে করোনার সময়ে পাচার করা সম্পদ অনেকেই কাজে লাগাতে পারেননি। এতে পাচারকারীদের মধ্যে ভয় ঢুকেছে। যে কারণে তারা পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে চায়।

এ অর্থ দেশে আনতে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও আয়কর অধ্যাদেশ, দুর্নীতি দমন আইনের কিছু ধারা থেকে তাদের অব্যাহতি দিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সার্কুলার জারি করে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা থেকে পাচারকারীদের অব্যাহতি দিতে হবে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন বাস্তবায়নের প্রধান সংস্থা বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ আইন থেকে পাচারকারীদের অব্যাহতি দিতে কাজ করতে হবে বিএফআইইউকে। দুটি সংস্থার পক্ষেই এটি করা কঠিন। কেননা, তাদের আন্তর্জাতিক মানদ- রক্ষা করে কাজ করতে হয়। পাচার করা টাকা ফিরে এলে বাংলাদেশে দুভাবে মানি লন্ডারিং হয়েছে বলে প্রমাণিত হবে। এক. দেশ থেকে টাকা পাচার সুযোগ রয়েছে এবং দুই. পাচার করা টাকা দেশে এসেছে এটা প্রমাণ হবে। এ দুটোই মানি লন্ডারিং। বর্তমানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকিমুক্ত দেশ। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউ পাচারকারীদের সুবিধা দিলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারা প্রশ্নের মুখে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বিষয়টি নিয়ে তারা হুট করে কিছু করবেন না। এ বিষয়ে আইনগত মতামত নেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোও দেখা হবে।

বিএফআইইউর সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্সের সভায় পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বেশকিছু প্রস্তাব এসেছিল। এর মধ্যে ছিল দেশ থেকে পাচার করা অর্থের ওপর জরিমানাসহ আয়করের পাশাপাশি পরোক্ষ কর (ভ্যাট বা শুল্ক) আরোপ করে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া। একই সঙ্গে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগের পাশাপাশি শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগকেও সংযুক্ত করার। সভায় এ বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা শেষে বিষয়টি নিয়ে আরও সমীক্ষার কথা বলা হয়। এ বিষয়ে কিছু কাজও হয়েছে। এর অংশ হিসাবেই বাজেটে এ প্রস্তাবটি রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আয়কর অধ্যাদেশের বিষয়ে এনবিআর ও দুর্নীতি দমন আইনের ব্যাপারে দুদক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। এক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব আইন থেকে আলাদাভাবে অব্যাহতি দেওয়ার বাইরেও আরও একটি পথ খোলা রয়েছে। সেটি হচ্ছে অর্থবিল। বাজেটের অর্থবিল হচ্ছে একটি আইন। এখানে আইনি শর্ত যুক্ত করে পাচারকারীদের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না করার জন্য সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা দেওয়া হলে অন্য কোনো সংস্থার পক্ষে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না। তবে আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিংয়ের দিক থেকে এটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এছাড়া বাজেটের সুশাসনের দিক থেকেও প্রশ্ন উঠবে। কেননা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেই তা নিয়ে সরকারকে তীব্র সমালোচনা সহ্য করতে হয়। টাকা পাচারকারীদের ছাড় দিলে আরও বেশি সমালোচনা হবে। ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে সমালোচনা শুরু হয়েছে।

এদিকে এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হলেও পাচারকারীরা তার কতটুকু ব্যবহার করবেন-সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কেননা, পাচার করা টাকা দেশে এনে ব্যাংকে জমা করতে হবে। এর বিপরীতে নির্ধারিত হারে কর দিতে হবে। ফলে যারা টাকা ফিরিয়ে আনল তাদের একটি রেকর্ড থেকে যাচ্ছে। এই সরকার হয়তো কিছু করলো না। ভবিষ্যতে অন্য সরকার ক্ষমতায় এলে তারা প্রচলিত আইন বাতিল করে সুবিধাভোগীদের আইনের আওতায় আনতে পারবে। ফলে সুবিধাভোগীদের মধ্যে এ ভয়ও কাজ করবে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৩ মে এক সার্কুলার জারি করে বলেছে, প্রবাসীদের যে কোনো অঙ্কের রেমিট্যান্স দেশে আনার ক্ষেত্রে কোনো আয়ের উৎস জানাতে হবে না। রেমিট্যান্সে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়। এ খাতে অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫ হাজার ডলার বা ৫ লাখ টাকার বেশি রেমিট্যান্স পাঠালে আয়ের উৎস জানানোর বিধান করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় সেটি এখন তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে রেমিট্যান্সের নামে পাচার করা টাকাও এখন আসতে পারে।

সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিদেশ থেকে সম্পদ নিজ দেশে আনার সুযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, গ্রিস, নরওয়ে, স্পেন ইত্যাদি। এসব দেশে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাব উন্মুক্ত। অর্থাৎ যে কোনো সময় দেশ থেকে বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করা যায়। ফলে কর ফাঁকি না দিলে তা ফিরিয়ে আনতে কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাব উন্মুক্ত নয়। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিদেশে নিয়মের বাইরে অর্থ নেয়া অপরাধ। বাংলাদেশে ওই আইনটি এত কঠিন যে, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কোনো বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে ৬ মাসের কম অবস্থান করলে বিদেশে কোনো ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারবে না। ওই হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করতে পারবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক দেশ-বিদেশ থেকে টাকা দেশে আনার সুযোগ দিয়েছে। তাদের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এ দেশেরটা মিলবে না। ওইসব দেশ থেকে অর্থ নেয়া কোনো অপরাধ নয়। কর ফাঁকি দেয়া অপরাধ। এ দেশে নিয়মের বাইরে অর্থ নেয়া যেমন অপরাধ, তেমনি কর ফাঁকিও অপরাধ।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More