স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় নির্বাচনে কমপক্ষে ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করার কথা বলেও এখনো দোদুল্যমান নির্বাচন কমিশন। এখন তারা বলছে, এটা নির্ভর করছে সরকারের চাওয়া এবং অর্থ বরাদ্দের ওপর। একজন নির্বাচন কমিশনার ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘সরকার নতুন ইভিএম কেনার জন্য বরাদ্দ না দিলে ৭০-৮০টি আসনে হতে পারে।’ আর এই কথার জবাবে একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘তারা নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।’ নির্বাচন কমিশন এরইমধ্যে ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করার জন্য দুই লাখ ইভিএম কিনতে আট হাজার ৭১১ কোটি টাকার আর্থিক প্রস্তাব পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রস্তাব পাঠানোর পর মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ভোটের বিষয়ে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, এটা নির্ভর করবে যদি সরকার এই প্রকল্প অনুমোদন করে। এর আর্থিক সংশ্লিষ্টতা যেটা আছে, সেটা যদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে যথার্থ মনে না হয়, তাহলে সরকার এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদন না-ও করতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যেটা চাচ্ছি, ইভিএম বা ব্যালট মূল কথা নয়। মূল কথা হলো সবাইকে চেষ্টা করতে হবে একটা সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ, নির্বিঘ্ন ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ইভিএম থাকল, না কি ব্যালট থাকল, সেটা বড় কথা নয়।’
গত ২৩ আগস্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত জানান। বর্তমানে কমিশনের ৭০-৮০ টি আসনে ইভিএমে নির্বাচন করার সক্ষমতা আছে। এর আগে কমিশন ধারাবাহিক সংলাপ করে। বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল ওই সংলাপে যায়নি। সংলাপে অংশ নেয়া দলগুলোর একাংশ এবং বিএনপি ও আরো কিছু রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছিলো। তবে নির্বাচন কমিশন ১৫০ আসনে ইভিএমের নিদ্ধান্ত নেয়ার পর দোদুল্যমানতার প্রকাশ ঘটতে শুরু করে। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন ইভিএমে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। তবে মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে ইভিএম কিংবা ব্যালট পেপার কোনোটাতেই সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা নেই।’
গত ১৯ সেপ্টেম্বর আট হাজার ৭১১ কোটি টাকার ইভিএম প্রকল্প প্রস্তাব কমিশন অনুমোদন করে। এই প্রকল্পের আওতায় দুই লাখ ইভিএম কেনা হবে ছাড়াও ইভিএম সংরক্ষণ, জনবল তৈরি ও প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় রাখা হয়েছে।
এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকেও আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাজেটের অতিরিক্ত আরো এক হাজার ২২৫ কোটি টাকার নিরাপত্তা সরঞ্জাম কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ, মোটরযান ও জ্বালানি, গোয়েন্দা, অপারেশনাল ও নিরাপত্তা সামগ্রী।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ‘এখন বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক সংকট চলছে। তাই তারা ধারণা করছেন নির্বাচনের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ সরকার নাও দিতে পারে। তাই তারা আগেই প্রস্তুত থাকছেন।’
নির্বাচন কমিশনার রাশিদা সুলতানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করতে চাই। এটা কমিশনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নাই। এখন সরকার যদি অর্থ বরাদ্দ দেয় তাহলে হবে। তা না হলে ৭০- ৮০টি আসনে করার আমাদের সক্ষমতা আছে সেই আসনগুলোতে আমরা ইভিএমে করব।’
তার কথা, ‘আমরা দেখেছি ইভিএমে নির্বাচন হলে কারচুপি করা সম্ভব নয়। আমরা যদি জাতীয় নির্বাচন ইভিএমে করতে পারি তাহলে এটা একটা পরীক্ষাও হবে। নির্বাচন খারাপ হলে সবাই বর্জন করবে। আর ভালো হলো এটা সবাই ভবিষ্যতেও চাইবে।’ তিনি জানান, ‘আমরা যে বরাদ্দ চেয়েছি সেটা শুধু ইভিএম নয়, এগুলো সংরক্ষণ, পরিবহণের জন্য গাড়ি, প্রশিক্ষণ এসব কাজেও টাকা ব্যয় হবে। আমাদের বরাদ্দ প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশন হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে। তবে সরকার বরাদ্দ দেবে কী না তা আমরা জানি না। এনিয়ে সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো কথা হয়নি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ না ভালো তা আমার জানা নাই। নির্বাচন করতে হলে তো টাকা খরচ করতেই হবে। ব্যালট পেপারে নির্বাচন করলেও তো টাকা খরচ হবে। টাকা ছাড়া তো আর নির্বাচন হবে না।’
তার কথা, ‘কোন রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে, কোন দল বিপক্ষে সেটা আমরা ভাবছি না। সেটা আমাদের বিবেচনার বিষয়ও নয়। আমরা চাই একটি কারচুপি মুক্ত নির্বাচন। ব্যালট পেপারে কেমন নির্বাচন হয় তা তো আপনার এর আগে দেখেছেন।’
তবে সাবেক নির্বাচন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এতটা দোদুল্যমান হতে পারেনা। আমার মনে হয় এখনো তারা বুঝে উঠতে পারছেন না যে তাদের দায়িত্বটা আসলে কী। মনে হচ্ছে এজেন্ডাবিহীন আলোচনা করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন খেই হারিয়ে ফেলেছে।’ তিনি বলেন, ‘আসলে তারা অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধীতার মুখেও তারা ইভিএম নিয়ে আছে। সেখানে ৯ হাজার কোটি টাকা লাগবে। তারপর তারা সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা লাগাবে বলছে। তাদের তিন-চার লাখ সিসি ক্যামেরা কিনতে হবে। এর দাম সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে কী না জানিনা। এরপর পুলিশ চাইছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা, আনসার এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা চাইবে, সেনাবাহিনী দুই হাজার কোটি টাকা চাইবে। এত খরচ কোথা থেকে আসবে? দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কি তারা ভেবে দেখেছেন? ‘এখন আবার শুনছি ছয় কোটি মানুষের ১০ আঙ্গুলের ছাপ নেবেন তারা। এটা কি এত সহজ? আমরা যখন আঙ্গুলের ছাপ নিয়েছি তখন এটা সেনবাহিনি একক ভাবে কাজটি করে দিয়েছে বলে সম্ভব হয়েছে। নতুন করে আবার কেন ছাপ নিতে হবে আমি বুঝি না,’ বলেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি মনে করেন, ‘এই কমিশন এখন তালাগোল পাকিয়ে ফেলছে। নির্বাচন নিয়ে তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।’
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ