আস্থার সঙ্কটে খাদের কিনারে শেয়ারবাজার : থামছে পতন
ডলারের বিপরীতে টাকার মান এবং রিজার্ভ কমে যাওয়ায় হারাচ্ছে মূলধন
স্টাফ রিপোর্টার: মুদ্রাবাজারের চাপে খাদের কিনারে দেশের শেয়ারবাজার। ডলারের বিপরীতে টাকার মানে অবনমন এবং রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বিক্রির আদেশ বাড়ায় শেয়ার মূলধন হারাচ্ছে বাজারটি। শেয়ারের দর কমার সর্বনিম্ন সার্কিট কমিয়ে দেয়ার পরও বড়পতন থামানো যাচ্ছে না। বিদেশী ও প্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কটে টানা ছয় কার্যদিবস দরপতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। এই সময়ে প্রধান শেয়ারবাজারে সার্বিক সূচক কমেছে ৩৫৬ পয়েন্ট। আর বিনিয়োগকারীরা মূলধন হারিয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। নগদ টাকার অভাব এবং নানামুখী গুজবে বিনিয়োগকারীরা ২০১০ সালের ধসের স্মৃতি স্মরণ করছেন। তবে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতিতে শঙ্কিত হয়ে বিদেশী, প্রাতিষ্ঠানিক, বড় ও সাধারণ সবশ্রেণীর বিনিয়োগকারীই এখন বাংলাদেশে শেয়ারের বিক্রেতা। সেই তুলনায় শেয়ারের ক্রেতার সংখ্যা কম। রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানিক ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত চাওয়ায় শেয়ার বিক্রি আগুনে ঘি ঢেলেছে। দেশের শেয়ারবাজারের সঙ্কটের সময়ে যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইতোপূর্বে ক্রেতার ভূমিকায় ছিল, ঠিক সেই প্রতিষ্ঠানটি বিক্রেতা হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনোবলে ভয়ানকভাবে আঘাত লেগেছে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিকদের তারল্য প্রবাহে সঙ্কটের কারণে নতুন করে মার্জিন ঋণ প্রদান কমে গেছে। আর শেয়ারবাজারে নাজুক পরিস্থিতিতে ক্রেতারা নতুন ঋণ নিতেও চাচ্ছেন না। সবমিলে শেয়ারবাজারে অস্থির সময় পার করছে। প্রতিদিনই শেয়ারের ক্রেতা সঙ্কট দেখা যাচ্ছে।
মুদ্রাবাজারে ডলারের দর ব্যাপকভাবে ওঠানামা করায় শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। নতুন বিনিয়োগ আসার পরিবর্তে প্রত্যাহার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মঙ্গলবার ব্যাংকে ডলারের দর ৮৮-৮৯ টাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও মুদ্রাবাজারে ১০০ টাকার ওপরে উঠে যায়। বুধবারেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। ব্যাংকের চেয়ে ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি দরে ডলার কেনাবেচা হয়েছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ডলারের দর ১০৪ টাকা পর্যন্তও উঠেছিলো। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান ৯৮ টাকাতেও বাইরে ডলার বিক্রি করেছে। মূলত ডলারের দরে ব্যাপক তারতম্যে বিদেশীরা সতর্কভাবে লেনদেন করছেন। একইভাবে রিজার্ভও কমে গেছে। এছাড়া দেশের বাজারে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দরে ব্যাপক তারতম্য ঘটেছে গত কয়েকদিনে।
সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাটের অভিযোগে প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে) হালদার এবং তার সহযোগীরা আটক হয়েছে। পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ারবাজারে অন্তত অর্ধডজন কোম্পানির শেয়ার কিনেছিল। ভারতে তারা গ্রেফতার হলেও তাদের বাংলাদেশ থাকা সহযোগীদের মধ্যে নতুন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সেই কারণে শেয়ারবাজারে তাদের টাকা প্রত্যাহারের গুজব রয়েছে। এটিও শেয়ারবাজারে পতনের অন্যতম কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোন উদ্যোগে দরপতনের ধারায় পরিবর্তন হচ্ছে না। কয়েকদিন ধরেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিবি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত দেয়ার সময়সীমা বাড়ানোর পরামর্শ দেন। এছাড়া ডিএসইর কাছ থেকে আইসিবির কাছে ১শ’ কোটি টাকার নতুন ফান্ডের ব্যবস্থা করেন। তবুও কোন কাজ হচ্ছে না। উল্টো শেয়ারবাজারে টানা পতন ঘটছে। বুধবারে প্রধান শেয়ারবাজারে সূচক কমেছে ৯৩ পয়েন্ট। অপরদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কমেছে ১৭০ পয়েন্ট। উভয় স্টক একচেঞ্জেই সূচকের পাশাপাশি কমেছে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম ও লেনদেন। গত ১১ মে ডিএসইতে সূচক কমেছে ৭৩ পয়েন্ট, পরদিন কমেছে ২৭ পয়েন্ট। আর ১৬ মে একদিনে কমেছে ১৩৪ পয়েন্ট। যা গত ৯ মাসে সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। ঠিক পরের দিন ২৭ পয়েন্ট কমলেও বুধবারে একদিনে ৯৩ পয়েন্ট কমল। এভাবে প্রতিদিনই সূচক কমছে। আর বিনিয়োগকারীরা নিজেদের মূলধন হারাচ্ছেন।
সম্প্রতি বিএসইসি দরপতন ঠেকাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত রাখে। মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে ব্রোকার ডিলারের বিনিয়োগ বাড়ে ২০০ কোটি টাকা। এছাড়াও আইসিবির বিনিয়োগ যাতে বৃদ্ধি পায়, তারা যেন বাজারকে সাপোর্ট দিতে পারে, সেই জন্য ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু আইসিবির রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমানের বিনিয়োগ করা ফেরত দিতে গিয়ে বড় ধরনের বিক্রির চাপ দিতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে ওষুধ ও রসায়ন খাতের একটি কোম্পানি এসিআই ফর্মুলেশনের প্রায় ১০০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করতে হয়েছে। এছাড়া অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করতে হয়েছে।
বুধবার বাজারে ৩৭৯টি প্রতিষ্ঠানের ২০ কোটি ৬০ লাখ ১১ হাজার ৭৮৭টি শেয়ার ও ইউনিট কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে ৪২টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ৩১০টির, আর অপরিবর্তিত রয়েছে ২৯টির।
অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমায় এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক আগের দিনের চেয়ে ৯৩ দশমিক ৯৮ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৩০৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে কমেছে ১৭ পয়েন্ট এবং ডিএস-৩০ সূচক কমেছে ২৭ পয়েন্ট। বুধবার ডিএসইতে ৭৬২ কোটি ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিলো ৭৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকার শেয়ার। অর্থাৎ আগের দিনের চেয়ে লেনদেন কিছুটা কমল।
বিএসইসি ও আইসিবি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শেয়ারবাজার ইস্যুতে বাজারবান্ধব চার সিদ্ধান্তের পরও সূচকের বড় ধরনের দরপতন নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সবার ধারণা শেয়ারবাজার দরপতনের পেছনে অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এখনই বাজারবান্ধব সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের বাইরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে রোড শো, নতুন ট্রেক ইস্যু, এসএমই প্ল্যাটফর্ম চালু এবং ওটিসি মার্কেট বিলুপ্ত করে কোম্পানিগুলোকে লেনদেনযোগ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া বন্ধ এবং লোকসানে থাকা কোম্পানিগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালক বিনিয়োগ দিয়ে চালুর চেষ্টাও করছে বিএসইসি।
ডিএসই ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে এখন আর কথা বলতে ভাল লাগে না। বাজারের আচরণ নিয়ে শঙ্কিত। বর্তমান বাজার পুরোপুরি গুজব নির্ভর হয়ে পড়েছে। নানা গুজবের ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে।
মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, বাজার এখন পুরোপুরি গুজব নির্ভর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন রকমের ধরনের গুজব চলছে। এতদিন বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়া নিয়ে অহেতুক গুজব ছিল। সেই গুজবে কান দিয়ে ছোট-বড় বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অথচ এই চরম সঙ্কটের মধ্যেও মঙ্গলবারও শ্রীলঙ্কার শেয়ারবাজারে সূচক কিন্তু ৪০০ পয়েন্ট বেড়েছে। অথচ আমাদের বাজারে দরপতন হচ্ছেই। বুঝতে পারছি না, কেন এমন হচ্ছে। মনে হচ্ছে সবাই গুজবের পেছনে ছুটছে।