আর্থিক খাত সংস্কারে চাপ : ৩৮ শর্তের বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চায় আইএমএফ

ঋণের পরবর্তী কিস্তির টাকা নিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে

স্টাফ রিপোর্টার: ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার ও রাজস্ব খাতসহ সরকারের বেশকিছু নীতি সংস্কারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ বাড়ছে। এরমধ্যে খেলাপি ঋণ, রাজস্ব ছাড় ও ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তাই সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে কি থাকছে, এর বিস্তারিত তথ্য জানতে চাওয়ার পাশাপাশি ঋণের অর্থ ব্যবহারের অগ্রগতিও জানতে চেয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে। সূত্র জানায়, প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করবে। গত ৩০ জানুয়ারি বর্ধিত ঋণ সুবিধার (ইসিএফ) আওতায় ৩৩০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় আরও ১৪০ কোটি ডলারসহ মোট ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। ঋণ অনুমোদনের তিন দিন পরই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করে সংস্থাটি। প্রথম কিস্তি ছাড়ের পর গত মার্চ পর্যন্ত অর্থ ব্যবহার ও সংস্কারের অগ্রগতি জানতে গত মঙ্গলবার আইএমএফ প্রতিনিধি দল ঢাকা আসে। আগামী ২ মে পর্যন্ত তারা ঢাকা অবস্থান করবে। দলটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে। জানা গেছে, আইএমএফের ঋণের পরবর্তী কিস্তির টাকা নিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। শর্তগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর্থিক খাতের মধ্যে আবার বড় অংশজুড়ে রয়েছে ব্যাংক খাত, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে। এর মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত অর্জন এবং আগামী জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে তার বাস্তবায়ন পরিস্থিতি যাচাই করবে এ মিশন। এছাড়া ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে যেসব শর্ত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে সরকার, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আসন্ন বাজেটে কী কী উদ্যোগ থাকছে, তা-ও পর্যালোচনা করছে দলটি। ইতোমধ্যে সচিবালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এ সময় বিদায়ী বছরের (২০২২) ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। এটি মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। আগের বছরে (২০২১) ছিলো ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এতে দেখা গেছে, শুধু ডিসেম্বরেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ডিসম্বেরে খোলাপি ঋণ বৃদ্ধির চিত্র দেখে প্রতিনিধি দল কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কেন খেলাপি ঋণ নামিয়ে আনা যাচ্ছে না, তা জানতে চেয়েছে দলটি। এ সময় খেলাপি ঋণ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা হবে বলে প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকে প্রতিষ্ঠানটির কাছে আগামী বাজেটে কর অব্যাহতির অঙ্ক জানতে চেয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি কর-জিডিপি অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে কর ব্যবস্থা সংস্কার ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর রূপরেখা চেয়েছে। দেশের মোট রাজস্বের ৮০ শতাংশের বেশি আদায় করে এনবিআর, যার মধ্যে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য খাত থেকে আদায় হয় প্রায় ১০ শতাংশ রাজস্ব। রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে এই রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস বিভাগে বকেয়া রাজস্ব কয়েক হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু বিপিসির কাছ থেকে আট হাজার কোটি টাকা না পাওয়ার বিষয় আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর। বিষয়টি জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফের প্রতিনিধিরা। বিপিসি টাকা কেন দিচ্ছে না। এখানে মামলা বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না তাও জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এছাড়াও আগামী অর্থবছরে নিয়মিত শুল্ক-কর আদায়ের অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো সংগ্রহ করতে হবে। কমাতে হবে কর ছাড়।

ভ্যাট বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি দল ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন, অটোমেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। এক্ষেত্রে এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিষয়টির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। অটোমেশনের কাজও দ্রম্নত এগিয়ে চলছে। আয়কর বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে করজাল বাড়ানোর ক্ষেত্রে এনবিআর কীভাবে কাজ করছে তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটিকে জানানো হয়েছে, কোন খাতে কত কর ছাড় আছে, কোনটি বাদ দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকায় এসেই আইএমএফ প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে বসে। বৈঠকে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া চায় আইএমএফ। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ নিয়ে সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে জানতে চেয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের সর্বশেষ অবস্থা। ঋণের অর্থ ব্যবহারের অগ্রগতি এবং অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের হালনাগাদ তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর থেকেই পরামর্শ অনুযায়ী আর্থিক খাতের কাঠামো ও নীতি সংস্কারের বেশ কিছু শর্ত ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানিয়েছেন, প্রতিনিধি দল আইএমএফের ঋণ ব্যবহারের অগ্রগতিসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিষয়ের হালনাগাদ তথ্য নিয়ে আলোচনা করেছে। এই সফরটি আইএমএফের কাজের একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। এর মধ্যে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়টিও রয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More