আগুন নিয়েও চলছে দোষারোপের রাজনীতি
পুড়ছে মার্কেট সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ীরা : নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশ
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে দোষারোপের রাজনীতি অনেকটা স্থায়ী সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। কোনো ঘটনা ঘটার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে। সব ছাপিয়ে ঘটনাটি তখন রাজনৈতিক ইস্যুতে রুপ নেয়। এভাবে দোষারোপের রাজনীতির কারণে বেশির ভাগ ঘটনারই প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন সম্ভব হয় না। কোনো ঘটনায় তৃতীয় পক্ষ ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করলেও তারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি দেশের মার্কেটগুলোয় একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটছে। এতে নিঃস্ব হচ্ছেন শত শত ব্যবসায়ী। এসব ঘটনার পেছনে নাশকতা রয়েছে কি না, চারদিকে সেই সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে আগুন নিয়েও শুরু হয়েছে দোষারোপের রাজনীতি। বড় দুটি দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এসব ঘটনায় সরাসরি একে অপরকে দায়ী করছে। তাদের এমন বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রতিটি ঘটনা নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে, যা মোটেও কাম্য নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। চাঞ্চল্যকর বা ভয়াবহ ঘটনার ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয়। এতে মূল তদন্ত ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘটনার সঙ্গে কারও জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়া হলে তদন্তকারীদের ওপর একটা মানসিক চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তদন্তের ক্ষেত্রে সরকারের চাওয়াপাওয়ার একটা প্রভাব পড়তে পারে। অতীতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে। এতে ঘটনার প্রকৃত কারণ থেকে যাচ্ছে অজানাই। অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। যেমন: ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর গঠিত তদন্ত কমিটির ক্ষেত্রেও প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেবার রাজনৈতিক প্রভাবে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে ‘জজ মিয়া’ নামে নাটক সাজায় তদন্তকারী সংস্থা। ৪ মার্চ ভয়াবহ অগ্নিকা-ে বঙ্গবাজারের কয়েকটি মার্কেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে পথে বসেন শত শত ব্যবসায়ী। এ ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পেছনে নাশকতা ছিলো বলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মনে একটা সন্দেহ শুরু থেকেই তৈরি হয়। যদিও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি নাশকতার কোনো আলামত পায়নি। বঙ্গবাজারের আগুনের রেশ কাটতে না কাটতেই শনিবার পুড়ে ছাই হয়ে যায় ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের কয়েকশ দোকান। এ অগ্নিকা-ের পর নাশকতার বিষয়টি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দুটি মার্কেটে আগুন লাগার সময় প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় এ সন্দেহ আরও জোরদার হয়। ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান সবাই। কিন্ত তদন্ত কমিটি গঠন এবং কাজ করার আগেই শুরু হয় দোষারোপের রাজনীতি। নিউ সুপার মার্কেট যেদিন আগুন লাগে, সেদিনই ছিলো আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা। গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নিসন্ত্রাসের কথা ভুলে যাবেন না। কারণ, তাদের অগ্নিসন্ত্রাস অন্য কোনো উপায়ে আছে কি না বা তারা বিভিন্ন উপায়ে তা ঘটিয়েছে কিনা, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’ সাম্প্রতিক অগ্নিকা-ের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আগুনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে তারা (বিএনপি-জামায়াত) ভিন্নপথ বেছে নিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত। আগে তারা সাধারণ মানুষকে পুড়িয়েছে। এখন তারা অর্থনীতিকে পঙ্গু করার পথ নিয়েছে কি না-আমাদের এই রহস্য বের করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যকে ‘দায়িত্বহীন’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওইদিনেই এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বলা উচিত ছিলো, এ ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তা না করে আগে থেকেই বলে দিচ্ছেন-এটার সঙ্গে বিএনপি জড়িত আছে কি না, সেটা দেখতে হবে। অর্থাৎ আগেই বলে দিচ্ছেন যারা তদন্ত করবে বা করতে পারে, তাদের ওই দিকে দেখতে হবে। অর্থাৎ উদ্দেশ্য একটাই-যেভাবেই হোক বিএনপিকে জড়িত করে দোষী সাব্যস্ত করা।’ এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, কোনো ঘটনার পর একে অপরকে দোষারোপ বাস্তবতাবিবর্জিত রাজনীতির যে প্রচলন, সেটারই বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল দিনদিন কমে যাচ্ছে। অতিরঞ্জিত বা অবাস্তব বক্তব্যই এখন আমাদের রাজনীতির মূলধারা। নিরপেক্ষভাবে আইনের প্রয়োগ না থাকায় তদন্তে প্রভাবিত হবে এবং রাজনৈতিক কারণে প্রকৃত ঘটনা আড়াল হবে, এটাই প্রচলিত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, কোনো ঘটনা ঘটার পর সরকারের পক্ষ থেকে আগ বাড়িয়ে কোনো মন্তব্য করা হলে নিরপেক্ষ তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার ওপর অবশ্যই মানসিক চাপ পড়বে। আর সরকার যখন কর্তৃত্ববাদী হয়, তখন এ প্রভাব আরও বেশি হয়। ১৫-২০ বছর আগে যে প্রভাব ছিলো, এখন আরও বেশি হচ্ছে। কোনো ব্যক্তি যদি নাশকতার পেছনে থাকেও, তখন তাকে বিএনপির ব্যক্তি বলে জাহির করা হয়। রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্তকতা থাকুক না থাকুক, তাকে বিএনপি বলে হাজির করানো হয়। কয়েকদিন ধরে একের পর এক মার্কেটে আগুন লাগছে। একই সঙ্গে চলছে আগুন নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি। রোববার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জ্বালাও-পোড়াও তাদের (বিএনপির) পুরোনো অভ্যাস। রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানে অগ্নিকা-ের সঙ্গে বিএনপি জড়িত থাকতে পারে। আন্দোলন জমাতে বিএনপি আগুন লাগানোর কৌঁশল বেছে নিল কি না, সেটা এখন বড় প্রশ্ন। এই রহস্য অবশ্যই উদ্ঘাটন করা হবে।’ ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেরও পালটা জবাব দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল সোমবার এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘চলমান আন্দোলন ও মানুষের বিভিন্ন দাবি থেকে জনদৃষ্টি ভিন্নখাতে নিতে ক্ষমতাসীনরা মার্কেটে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। সরকার খুঁজে বেড়াচ্ছে বিএনপি। কিছু হলে বিএনপি। উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর কৌশল।’ বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, অগ্নিকা-ের ঘটনার প্রকৃত কারণ নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসা উচিত। তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসুক, আমরা সেটাই চাই। তবে নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যাহত হয়-এমন কথা ও কাজ যেন না করি। ঘটনা ঘটার পরপরই নাশকতা বলা ঠিক নয়। বঙ্গবাজারে অগ্নিকা-ের পরও অনেকে নাশকতার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে এলো সিগারেট বা মশার কয়েল থেকে আগুনের সূত্রপাত। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের সময় নাশকতা বললে সেটার হয়তো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে। কিন্তু সাধারণ সময় নাশকতা ঘটাবে, সেটা হয়তো অনেকেই মনে করবে না। রাজধানীর মার্কেটগুলোয় অগ্নিকা-ের পর এমন সন্দেহ করা হলেও পরে তা প্রমাণিত হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এসব অগ্নিকা-ের ৩৮ শতাংশ শর্ট সার্কিট থেকে। গ্যাসের চুলা থেকে ১৮ শতাংশ।