লকডাউনের খবরে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে বিপণী বিতান ও হাট-বাজারে মানুষের ভিড়
বিভিন্নস্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা : সকলকে সরকারি নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ
স্টাফ রিপোর্টার: করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আজ সোমবার থেকে ৭ দিনের লকডাউনে পুরো দেশ। এরই প্রেক্ষিতে গতকাল রোববার চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদেহর বিভিন্ন বিপণী বিতান ও হাট-বাজারে ছিলো মানুষের উপচেপড়া ভিড়। তবে কেউই মানেননি সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি। ক্রেতারা যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানেননি; তেমনি মানেননি দোকানিরা। এদিকে সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে দোকান মালিক সমিতি। রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, একদিকে শুরু হচ্ছে লকডাউন। আবার সামনে আসছে রমজান মাস। এজন্য অনেকেই যেমন কাঁচাবাজারে যাচ্ছেন। অনেকে আবার কিনে রাখছেন কাপড়-চোপড়। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না কেউই। এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছেন।
চুয়াডাঙ্গায় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় নিয়মিত মাঠে কাজ করছে প্রশাসন। জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচার প্রচারণাসহ করা হচ্ছে মাস্ক বিতরণ। স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি নির্দেশনা অমান্য করায় জরিমানাও করছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরই ধারাবাহিকতা গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে যৌথ ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়। সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন উপলক্ষে শহীদ হাসান চত্বর থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে জনসাধারণের মাঝে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম মাস্ক ও লিফলেট বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার ও পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম। সেখানে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে করোনা সচেতনতায় নানা নির্দেশনা প্রচার করা হয়। ক্যাম্পেইনে উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার, পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাজিয়া আফরীন, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান, এনডিসি আমজাদ হোসেন, জেলা পরিবার পরিকল্পনার উপ-পরিচালক দীপক কুমার সাহা ও সিভিল সার্জন প্রতিনিধি ডা. আওলিয়ার রহমানসহ জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা।
সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনে জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে। আমরা চাইনা কাউকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কাউকে শাস্তি দিতে। তাই সকলকে সরকারি নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
অপরদিকে, লকডাউনের আগের দিন গতকাল রোববার চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের প্রায় প্রতিটি সড়কেই ছিলো ভিড়। বাজার বিপণী বিতানে সকাল থেকেই উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে শাড়ি কাপড় ও প্রসাধনীর দোকানগুলোতে নারী ক্রেতাদের ভিড় দেখে অনেকেরই চোখ উঠে কপালে। মুদি দোকানেও সারাদিন ছিলো কেনা কাটার ব্যস্ততা। কেনো এতো কেনা কাটা? অধিকাংশেরই একই জবাব, লকডাউন শুরু হচ্ছে। কবে আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তার কোন ঠিক নেই। তাছাড়া বন্ধের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যেরই দাম বেড়ে যায় বা বাড়িয়ে দেয়া হয়। এসব কারণেই লকডাউনের আগের দিন কিনে রাখা হচ্ছে। ব্যাংকেও ছিলো গ্রাহকের টাকা তোলার তোড়জোড়। চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার পুরাতনগলি, সমবায় নিউ মার্কেট, প্রিন্স প্লাজা, আব্দুল্লাহ শপিং কমপ্লেক্সসহ জেলা শহরের সবক’টি পোশাকের দোকানেই নারী ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে কেনা কাটায় ব্যস্ত নারীদের শুধু নিজেদের জন্য কেনা কাটা করতে দেখা যায়নি, শিশু পোশাকের দিকেই ছিলো অধিক ঝোক। আসন্ন পয়লা বোশেখ ও রোজার আগাম কেনাকাটার ভিড়ের কারণে করোনা ভাইরাস কতটা ছড়িয়েছে তা কে জানে! এরকমই দুশ্চিন্তার দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বলেছেন, বাজারে ভিড়ের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোন তাগিদই পরিলক্ষিত হয়নি।
অন্যদিকে, মাস্ক পরিধান না করা এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানায় চুয়াডাঙ্গায় ৭ জনকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল রোববার দুপুর ১২টার দিকে বড় বাজার এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান। এ সময় মাস্ক পরিধান না করা এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার অপরাধে ৭ জনকে ৬ হাজার ৫শ টাকা অর্থদ- প্রদান করেন। এছাড়াও বাস কাউন্টারগুলো যাতে বেশি ভাড়া আদায় না করে তার জন্য শতর্ক করে দেন।
এদিকে, জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি চুয়াডাঙ্গা ইউনিটের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনসাধারণের মাঝে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বার্তা প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি জেলার চার উপজেলায় পাঁচ দিনব্যাপী চলবে।
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাথে সমন্বয় করে জনসাধারণরে মাঝে কোভিড-১৯ বিষয়ক স্বাস্থ্য বার্তা দেশব্যাপী বিভিন্ন উপজেলা/জেলা সদরে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচার করছে। বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সংশ্লিষ্ট চুয়াডাঙ্গা ইউনিট ৫ দিনের জন্য স্বাস্থ্য বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক একটি পত্র পাঠিয়েছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার এ বিষয়ে রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের সেক্রেটারি শহিদুল ইসলাম শাহানকে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বার্তা প্রদানের ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করেন ও খোঁজখবর নিয়েছেন। রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের সেক্রেটারি শহিদুল ইসলাম শাহান বলেন, জেলার চার উপজেলায় মাইকিং করতে যুব রেডক্রিসেন্ট সদস্যদেরকে পাঠানো হয়েছে এবং চার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো পত্রটি প্রেরণ করা হয়েছে।
আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, শতভাগ মাস্ক পরিধান নিশ্চিতকরণে আলমডাঙ্গা উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। গতকার রোববার আলমডাঙ্গা শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে মাস্ক ব্যবহার না করার অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৩ জনকে জরিমানা প্রদান করা হয়েছে। আলমডাঙ্গা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. হুমায়ন কবীর এ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি জানান, শতভাগ মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই পজিটিভ ফলাফল আসছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশনা করোনাভাইরাস সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করা অবশ্য প্রয়োজন। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালে আলমডাঙ্গা থানার এসআই সুলতান মাহমুদ সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে উপস্থিত ছিলেন।
দামুড়হুদা অফিস জানিয়েছে, দামুড়হুদায় করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণপরিবহনসহ জনবহুল এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। গতকাল রোববার বেলা ১২টার দিকে দামুড়হুদা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালান উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিলারা রহমান। এ সময় গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, সর্বসাধারণের মাস্ক ব্যবহার না করা ও মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় পৃথক অপরাধে ৮ জনের কাছ থেকে ৩ হাজার ৮টাকা আদায় করা হয়।
গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী কমিটি গঠন করেছে মেহেরপুরের গাংনী পৌরসভা। এছাড়াও পথচারীদের মাঝে মাস্ক বিতরণ, সড়কে বি¬সিং পাউডার ছিটানো ও জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছে গাংনী পৌরসভা। গতকাল রোববার সকাল দশটার দিকে গাংনী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পথচারীদের মাঝে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করেন গাংনী পৌর মেয়র আহম্মেদ আলী, কাউন্সিলর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহবান জানান মেয়র আহম্মেদ আলী।
পৌরবাসী ও বাজারের দোকানিদের উদ্দেশে মেয়র আহম্মেদ আলী বলেন, আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেচাকেনা করুন। পৌরসভার সকল সড়কের বি¬চিং পাউডার ছিটানো হচ্ছে। পৌর এলাকায় কেউ যাতে মাস্কবিহীন প্রবেশ না করতে পারে সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যতে তা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়াও যার যার অবস্থান থেকে যদি আমরা সচেতন হই; তাহলে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন অনেকটাই সহজ হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘর থেকে বের হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, করোনা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যরাই জানেন এর প্র৬ভাব কতোটা ভয়াবহ। আমরা চায় না কেউ করোনা আক্রান্ত হোক। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জনিয়েছেন, ঝিনাইদহের শহরে বিভিন্ন বিপণী বিতান ও হাট-বাজারে বেড়েছে মানুষের ভিড়। কাপড় কিনতে আসা আসমা বেগম বলেন, ‘শুনেছি কাল থেকে লকডাউন। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে জানি না। আজকেই প্রয়োজনীয় কিছু কাপড় কিনে রাখলাম’। অপর ক্রেতা রকি বিশ্বাস জানান, লকডাউন কালকে থেকে শুরু। এরপর আবার রমজান মাস আসছে। তাই কিছু বাজার করতে এসেছি। স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে সদুত্তোর দিতে পারেননি কেউ। অন্যদিকে লকডাউনের ঘোষণায় হাটবাজারে মানুষের চলাচল বেড়ে যাওয়ায় সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে মাঠে নেমেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে এ অভিযান শুরু হয়ে চলে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। এ সময় গাদাগাদি করে কেনাকাটা করায় ও দোকানে স্যানিটাইজিং ব্যবস্থা না থাকায় দোকান মালিকসহ ২৯ জনকে বিভিন্ন অঙ্কে জরিমানা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হেদায়েত উল্লাহ বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে নিয়মিতই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। লকডাউনের কথা শুনে সাধারণ মানুষ বাইরে বেশি বের হয়েছে। ফলে হাটবাজার ও মার্কেটগুলোতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে অভিযান করছি।
মহেশপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল সন্ধ্যায় মহেশপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক বিতরণ করা হয়। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ‘আমার মাস্ক-আমার সুরক্ষা’এ সেøাগানকে সামনে রেখে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ মাস্ক বিতরণ করা হয়। মহেশপুর মেইন বাসস্ট্যান্ডে পথচারী, ভ্যান চালকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে এ মাস্ক বিতরণ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মহেশপুর পৌরসভার মেয়র আব্দুর রশিদ খাঁন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাশ্বতী শীল, থানা অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।