মাত্র ২ মিনিটে ৫৯ কোয়া খেয়ে বিলকিস বেগম জিতলেন প্রথম পুরস্কার
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ চত্বরে উদীচীর উদ্যোগে দিনভর জাতীয় ফল কাঁঠাল উৎসব উদযাপন
জহির রায়হান সোহাগ: চুয়াডাঙ্গায় হয়ে গেল গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঁঠাল উৎসব। কাঁঠাল নিয়ে জমজমাট আয়োজন ছিলো চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ চত্বরে। কাঁঠাল ফল ঘিরে হয়েছে গান, কবিতা আবৃত্তি, গল্প, আলোচনা সভা ও প্রতিযোগিতা।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী চুয়াডাঙ্গা জেলা সাংসদের উদ্যোগে চতুর্থবারের মতো আয়োজন করা হয় এই কাঁঠাল উৎসবের। সেখানে ২ মিনিটে কাঁঠালের সর্বোচ্চসংখ্যক কোয়া খেয়ে বিজয়ী হয়েছে কলেজের কর্মচারী বিলকিস বেগম। পুরস্কারেও পেয়েছেন আস্ত এক কাঁঠাল।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ চত্বরে গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় শুরু হয় এই উৎসব। চলে দুপুর পর্যন্ত। এর স্লোগান দেয়া হয় ‘কাঁঠালের বহু ব্যবহারে, প্রাণ-প্রকৃতি সুস্থ রাখে’। উৎসবে যোগ দেন চার উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ।
দিনভর নানা আয়োজনে মুখর ছিলো কলেজ প্রাঙ্গণ। কাঁঠালকথন, কাঁঠালরঙ্গ, আবৃত্তি, গান, সম্মাননা ও আলোচনা সভা শেষে করা হয় কাঁঠাল খাওয়ার প্রতিযোগিতা। তাতে অংশ নেন ৫৫ জন প্রতিযোগী। মাত্র ২ মিনিটে ৫৯ কোয়া কাঁঠাল খেয়ে একটি কাঁঠাল, একটি বই ও শুভেচ্ছা উপহার জিতে নেন কলেজের কর্মচারী বিলকিস বেগম। একই সময় ৪৯ কোয়া খেয়ে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার কর্মচারী নয়ন রায় দ্বিতীয় ও ৪৬ কোয়া খেয়ে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের ছাত্র আফিফ রহমান তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। তাদেরও দেয়া হয় উপহার। এছাড়া জেলার শ্রেষ্ঠ কাঁঠাল চাষি সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের তোক্কেল ম-লকে আলীকে সংবর্ধনা দেয়া হয় এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী ফল কাঁঠালের পরিচিতি রক্ষা ও গুণাগুন সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিতে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান উৎসব আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক শেখ আসমা চুমকি।
কাঁঠাল উৎসব উপভোগ করেন কয়েকশত দর্শক। প্রতি বছরই এমন উৎসব দেখতে চান তারা। কাঁঠাল উৎসব দেখতে আসা জাহানারা খাতুন জানান, বর্তমানে বাজারে বিদেশী ফলের আনাগোনা বেশি। তাদের ভিড়ে দেশীয় ফল আজ বিলুপ্তির পথে। আজ যে কাঁঠাল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে এখানে এসে খুব ভাল লাগছে। এখানে এসে কাঁঠাল ফল সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য জানতে পেরেছি। জানতে পেরেছি এর ঔষধি গুণাগুন সম্পর্কে। প্রতি বছরই এমন আয়োজন করার দাবি জানাচ্ছি। এর আগে আয়োজিত আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগাষ্ঠী চুয়াডাঙ্গা জেলা সংসদের সভাপতি হাবিবি জহির রায়হান। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. একেএম সাইফুর রশিদ, চুয়াডাঙ্গা সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আজিজুর রহমান, জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর রেজাউল করিম, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি দৈনিক মাথাভাঙ্গার সম্পাদক সরদার আল আমিন, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিটের সভাপতি নাজমুল হক স্বপন, সরকারি শেখ হাসিনা কলেজের অধ্যাপক হাফিজ উদ্দিন, চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক সফিকুল ইসলাম, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) উপ-পরিচালক জিএম জামিল সিদ্দিক, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি কোরবান আলী মন্ডল, জেলা লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সনি।
জাতীয় ফল কাঠাঁল উৎসবের সদস্য সচিব সাংবাদিক মেহেরাব্বিন সানভীর প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা উদীচীর সাধারণ সম্পাদক আদিল হোসেন ও জাতীয় ফল কাঁঠাল উৎসবের আহ্বায়ক শেখ আসমা চুমকি। কাঁঠালের ওপর প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজল মাহমুদ। পরে কাঁঠাল নিয়ে উন্মুক্ত গান, কবিতা ও গল্প শোনান অনেকেই।
অনুষ্ঠানে কাঁঠাল ফলের গুণাগুন ও গুরুত্ব তুলে ধরে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. একেএম সাইফুর রশিদ বলেন, কাঁঠাল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় খাওয়া যায়। কাঁচা কাঁঠাল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। কাঁঠাল পাকলে কোষ খাওয়া হয়। এ কোষ নিংড়ে রস বের করেও খাওয়া যায়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে খাওয়ার ধরণ পরিবর্তন করা প্রয়োজন। থাইল্যান্ডে কাঁঠালের চিপস তৈরি করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে কাঁঠাল জনপ্রিয় করার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুকিয়ে সংরক্ষণের পাশাপাশি স্যুপ, চিপস, রস (জুস), আইসক্রিম ইত্যাদি খাবার তৈরিতেও কাঁঠাল ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল আমাদের মাঝ থেকে যেনো হারিয়ে না যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কাঁঠাল শুধু সুস্বাদু খাদ্য না, আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির অংশ।
কাঁঠালের উপকারিতা নিয়ে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি সরদার আল আমিন বলেন, কাঁঠাল শুধু আমাদের জাতীয় ফলই নয়, খুবই পুষ্টিকর ও ভেষজগুণ সমৃদ্ধ, সুলভ ও উপকারী ফল। এর কা-, শাখা, পাতা, শেকড় কোনো কিছুই বাদ দেয়ার মতো নয়। কিন্তু ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা কাঁঠাল খেতে আগ্রহী নয় বরং তাদের মধ্যে বিরুপ মনোভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাহিদা না থাকায় মূল্য হ্রাস পাচ্ছে ফলে কাঁঠাল গাছ উজাড় হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের এই জাতীয় ফল কাঁঠাল। উদীচীর এই ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন মানুষের মধ্যে কাঁঠালের যে পুষ্টিগুণাগুণ আছে তার সঠিক ধারনা দিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আজিজুর রহমান বলেন, কোলস্টেরলমুক্ত এ ফলে নেই কোনো ক্ষতিকারক চর্বি। রয়েছে প্রচুর ক্যালরিসহ ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘সি’, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্ক এবং নায়াসিনসহ বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান। অন্যদিকে কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানবদেহের জন্য বিশেষ উপকারী। কাঁঠালে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস- আলসার, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম। কাঁঠালে আছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্রির্যা ডিকেলস থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। বদহজম রোধ করে কাঁঠাল। উদীচীর এই আয়োজন নতুন প্রজন্মের মাঝে জাতীয় ফল কাঁঠাল খাওয়ার উপকারিতাকে তুলে ধরছে যা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন বলেন, গ্রাম বাংলা সংস্কৃতির সাথে জড়িত কাঁঠালের বহু বহু মজার মজার কাহিনী আছে। রসিকতার ছলে হলেও, কাঁঠাল নিয়ে রঙ্গ তামাসাগুলোও বেশ জনপ্রিয়। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। এ ফলটি বহু প্রাকৃতিক গুণ আছে। আমাদেরকে কাঁঠালের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে মানুষের মাঝে জানতে হবে। স্মরণ রাখতে, বহু কিছু বিবেচনা করেই কাঁঠাল এদেশের জাতীয় ফল। কাঁঠালের সবকিছু কাজে লাগে। এমন যেনো না হয় যে, আমাদের জাতীয় ফলকেই আমরা ভুলে যাচ্ছি। চুয়াডাঙ্গায় জাতীয় ফল কাঁঠালের চাষ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এভাবে হ্রাস পেতে থাকলে কাঁঠাল গাছ বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হ্রাসের ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঁঠাল নিয়ে গবেষণার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। তার নির্দেশে কৃষি বিভাগ কাঁঠল নিয়ে গবেষণা করছে।