থমকে গেছে চুয়াডাঙ্গায় সরকারিভাবে বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান
সরকারি দামে চাল বিক্রি করলে মিলারদের লোকসান ৪ কোটি টাকা
স্টাফ রিপোর্টার: সরকারিভাবে চুয়াডাঙ্গায় ধান-চাল ক্রয় কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা আর সমন্বয়ের অভাবে কৃষকরা খাদ্য গুদামে ধান ও মিলাররা চাল দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ধান-চাল ক্রয়ের ১ মাসের বেশি সময় পার হলেও ৫৭ মে. টন ধান ও ১০৯৯ মে. টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। জীবননগর উপজেলা থেকে এখনও পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকের কাছ থেকে কোনো ধান সংগ্রহ করা হয়নি।
জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেছেন, ধান-চাল ক্রয়ের জন্য কৃষক ও মিলারদের সাথে কথা হচ্ছে। কিছু সমস্যা থাকায় বোরো মরসুমে ধান-চাল সংগ্রহে ব্যাহত হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার চালকল মালিক সমিতির সভাপতি জানান, সরকারি দামে গুদামে চাল দিতে হলে প্রায় ৪ কোটি টাকার মতো লোকসান হবে মিলারদের। এতো লোকসান দিয়ে চাল দেয়া সম্ভব না। কৃষকরা জানান, গুদামে ধান নিয়ে এলে বলা হয় ভিজা, টাকার জন্য ঘুরতে হয় বেশ কয়েক দিন। সাথে গাড়িভাড়া ও শ্রমিক খরচ লাগে। খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ এছাড়া নানা অজুহাত দেখান।
চুয়াডাঙ্গা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৩ মে চুয়াডাঙ্গায় সরকারিভাবে ধান-চাল ক্রয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ৫৩১০ জন নির্বাচিত কৃষকের কাছ থেকে ৫ হাজার ৩১০ মে. টন ধান ও ১৯৭ জন মিলারের কাছ থেকে ৭ হাজার ৬০৫ মে. টন চাল সরকারিভাবে ক্রয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় চলতি বোরো মরসুমে। সরকারিভাবে ধান কেনা হচ্ছে প্রতি কেজি ২৬ টাকা ও চাল ৩৬ টাকা দরে। চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলার ৫টি খাদ্য গুদাম থেকে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ও মিলারদের কাছ থেকে চাল কেনার জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে। জীবননগর উপজেলা থেকে এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো ধান ও চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। কিন্তু ১ মাস ৮ দিন পার হলেও সরকারিভাবে সামান্য পরিমাণে ধান-চাল সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে। ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৫৭ মে. টন ও চাল সংগ্রহ হয়েছে ১০৯৯ মে. টন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস চারটি উপজেলার ৫টি গুদামে সরকারিভাবে বোরো মরসুমে ধান-চাল সংগ্রহ করছে। গুদাম গুলো চুয়াডাঙ্গা সদর, সরোজগঞ্জ, দর্শনা, জীবননগর ও আলমডাঙ্গায়। চুয়াডাঙ্গা সদর থেকে ৬০৫, সরোজগঞ্জ থেকে ৪০৩, দর্শনা থেকে ১৪২৮, জীবননগর থেকে ১০২৯ ও আলমডাঙ্গা থেকে ১৮৪৫ মে. টন করে ধান কেনা হবে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদরে ৪, সরোজগঞ্জে ১, দর্শনায় ৫০, জীবননগরে শূন্য ও আলমডাঙ্গায় ২ মে. টন করে ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস। সরকারিভাবে জীবননগর থেকে ১০২৮ মে. টন ধান কেনার কথা থাকলেও কোনো ধান কিনতে পারেনি এখনও পর্যন্ত। জেলার ১৯৭ জন মিলারের কাছ থেকে ৭ হাজার ৬০৫ মে. টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৯ মে. টন চাল কেনা সম্ভব হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদরে প্রায় ২০, সরোজগঞ্জে শূন্য, দর্শনায় ৩৫, জীবননগরে ৯২৮ ও আলমডাঙ্গায় ১১৬ মে. টন করে চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু সরোজগঞ্জে ৫৯৫ মে. টন চাল কেনার কথা থাকলেও কোনো চাল কিনতে পারেনি।
চালকল মালিকরা বলছেন, ৭ হাজার ৬০৫ মে. টন চাল দিতে হলে আমাদের লোকসান হবে প্রায় ৪ কোটি টাকা। কারণ ভিজা ধান কিনতে হচ্ছে আজকে (শুক্রবার) ১০২০ টাকায় প্রতি মণ। প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৪১-৪২ টাকা। তাহলে কিভাবে সরকারি ৩৬ টাকা দরে প্রতি কেজি চাল বিক্রি করবো। প্রতি কেজি চালে মিলারদের লোকসান গুনতে হবে ৫-৬ টাকা। এ হিসাবে প্রায় ৪ কোটি টাকা লোকসান হবে। আমারা চালের দাম ২ টাকা বেশি দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে বলেছি। চাল নেয়ার জন্য আমাদের ৭০ দিন সময় দিতে হবে। এতো টাকা লোকসান দিতে হলে চালকল মালিকদের মিল বন্ধ করে দিতে হবে।
কৃষকরা বলছেন, সরকারিভাবে ধানের দাম প্রতি কেজি ২৬ টাকা হওয়ায় ধান বিক্রিতে তেমন আগ্রহ নেই। গাড়ি ভাড়া দিয়ে সরকারি গুদামে ধান নিলে লোকসান হয়। আর ধান দেয়ার পর ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে বেশ কয়েকদিন ঘুরতে হয়। আবার যেতে হয় শহরে ব্যাংকে। তাই স্থানীয়ভাবে ধান বিক্রি করলে লাভ হয় ও ঝামেলা নেই। খাদ্য গুদামে নিলে তারা নানা অজুহাত দেখায়। বলে ধান ভিজা আছে শুকিয়ে নিয়ে আবার আসেন। ধান বিক্রি করতে গেলে কৃষকদের হয়রানি ও বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়।
পার দামুড়হুদার কৃষক হান্নান আলী বলেন, সরকারিভাবে ধানের দাম অনেক কম হওয়ায় গ্রামে বিক্রি করেছি বেশি দামে। ধান নিয়ে গাড়ি ভাড়া দিয়ে দর্শনা যেতে হতো। সেখানে নানা টালবাহানা করে। বলে ধান ভিজা শুকিয়ে নিয়ে আসতে হবে। দিন কামায় যায়। টাকা তুলতে ব্যাংকে ঘুরতে হয়। এসব ভোগান্তির কারণে গুদামে ধান বিক্রি করি না। ধান নিয়ে গুদামে গেলে দুই দিনের জন্য কামায় হবে।
দামুড়হুদা উপজেলার নাপিতখালী গ্রামের কৃষক ফকির মোহাম্মদ জানান, গুদামের লোকজন ধান নিয়ে গেলে মেশিন দিয়ে মেপে বলে তোমার ধান ভিজা আছে। বিক্রি করতে হলে মণে কয়েক কেজি দিতে হবে না হলে শুকিয়ে নিয়ে এসো। গুদামে ধান বেঁচে গাড়ি ভাড়ার টাকা দিতে হয় ৫শ’ টাকা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রেজাউল ইসলাম বলেন, বাইরে ধানের দাম বেশি থাকায় কৃষকরা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের গুদামে দিচ্ছে না। ব্যাংককে কৃষকদের ঘোরাঘুরি লাগে। হাটে-আড়তে ধান বিক্রি করলে ধান ভিজা আছে এ সমস্যায় পড়তে হয় না। কিন্তু আমরা ভেজা থাকলে ধান কিনি না। বাইরের বাজারে ধান ও চালের দাম বেশি হওয়ায় সরকারিভাবে সংগ্রহ তেমন একটা নেই। কৃষক ও মিলারদের সরকারি খাদ্য গুদামে চাল-ধান দিলে সমস্যায় পড়তে হয় বলে তিনি স্বীকার করেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ শেখ বলেন, খাটো বাবু ধান আজকে কিনলাম হাটে ১০২০ টাকা দরে। ধান আবার ভিজা আছে। সরকারিভাবে দাম পাবো ৩৬ টাকা। এখন প্রতি কেজি ধান থেকে চাল তৈরি করে তা দাঁড়াবে ৪১-৪২ টাকায়। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসের সাথে আমারা চুক্তি করেছি তাই নিয়ম মেনে চাল দেবো। কিছুদিন বাড়তি সময় দিলে চাল দিতে পারবো। ৪ কোটি টাকা লোকসান হবে ৩৬ টাকা কেজি দরে চাল দিলে। কর্তৃপক্ষকে বলেছি ২ টাকা বাড়তি দিলে চাল দেয়ার চেষ্টা করবো। চালে লোকসানের সময় কাউকে পাশে দেখছি না কিন্তু সুসময়ে অনেককেই দেখা যায়। এতোটাকা লোকসান দিয়ে চাল দিতে হলে অনেকের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। এ পর্যন্ত গুদামে ১০৯৯ মে. টন চাল সরবরাহ করেছি আমরা।
জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, চাল আমি পেয়ে যাবো কিন্তু ধানের ব্যাপারে সমস্যা রয়েছে। বাজারে দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা খাদ্য গুদামে আসতে চায় না। চেষ্টা করছি ধান ও চাল কেনার জন্য। হাতে দেড় মাসের মতো সময় আছে এখনও। সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছি।