স্টাফ রিপোর্টার: আজ সন্ধ্যায় শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে কাল রোববার সারাদেশে যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভার্যের মধ্যদিয়ে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। আজ সন্ধ্যার আকাশে শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলেই রেডিও-টিভিতে বেজে উঠবে সেই চিরায়ত গান- ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর চলমান বিষাদময় সময়ে এ বছর মুসলমানদের জীবনে ঈদ এসেছে বলে এবার জনজীবনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদে ঈদের সেই উৎসবের আমেজ নেই। তবে ধর্মীয় অনাবিল আনন্দের অপেক্ষায় সবাই। আজ চাঁদ দেখা না গেলে রমজান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করে আগামী সোমবার ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। তবে এবার দেশের কোনো ঈদগাহে ঈদের জামাত বা নামাজ অনুষ্ঠিত হবে না। নিয়ম মতো সবকিছুই হবে। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ছাদে ছাদে উৎসুক নয়ন মেলে বসে থাকা। ঈদের জামাতে নামাজ পড়া, বাসায় এসে সেমাই পায়েস খাওয়া। সবকিছু থাকলেও যেন বাঙালির ঈদের সেই আনন্দ থাকবে না ঘরে ঘরে। বাংলাদেশে ঈদ মানেই নাড়ির টানে ঘরে ফেরা। রাস্তায় জ্যামের ভোগান্তি, টিকিট কেনার ঝক্কি ঠেলে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে যাবার যে তীব্র আনন্দ এবার বাঙালির জীবনে তা নেই। কারণ, এবার বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। মিলবে না প্রিয়জনের স্নেহমাখা স্পর্শ। স্মৃতিঘেরা বাড়ি, পাড়া-মহল্লায় আড্ডাও জমবে না এবার। অনেকের কাছেই ঈদ হবে নিরানন্দের। এবারের ঈদ যেন এক অচেনা ঈদ হয়ে ধরা দেবে সবার কাছে। ঈদ তো শুধু আনন্দ উপলক্ষ্য নয় বাঙালি মুসলমানের কাছে এটা এক ধরনের মিলন মেলাও। ঈদ এলেই মানুষের বাড়ির টানের তীব্রতা চোখে ধরা পড়ে বেশি। সীমাহীন যানজট উজিয়ে, বেশি ভাড়া গুণে, পথের নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে তারা ফিরতে চায় তার ফেলে আসা স্মৃতিগন্ধমাখা বাড়িতে, প্রিয় মানুষগুলোর কাছে। মনের কোনে বারবার হাতছানি দেয় সেই মেঠো পথ, জমির আল ধরে ধানখেতের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, সবুজ গাছের সারি, নদীর পানিতে ঝাপাঝাপি আর দল বেঁধে মাছ ধরার স্মৃতিময় দিনগুলো। এবার বদলে গেছে ঈদের দৃশ্যপট। চাঁদ দেখা গেলে এক দিন বাদেই ঈদ। অথচ, প্রতি বছরের মতো এবার ঈদে বাড়ি ফেরার সেই বিশাল কর্মযজ্ঞ নেই। বরং, বাড়ি না যাওয়ার জন্য রাস্তা জুড়ে কড়াকড়ি। বাস, ট্রেন বন্ধ। রাস্তাঘাট ফাঁকা। বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালে নেই বাড়ি ফেরার মানুষের ভিড়। আগে বাড়ি যাওয়া ছিলো আনন্দের। আর এখন বাড়ি ফেরা আটকাতে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে ফেরিঘাট। এই করোনাকাল মানুষের চালচিত্র বদলে দিয়েছে পুরোপুরি। লকডাউন ৩০ মে পর্যন্ত বৃদ্ধির পরেই বোঝা গিয়েছিলো এবার ঈদ আগের মতো হবে না। শপিংমলে নেই ক্রেতাদের ভিড়। ঈদের কেনাকাটা বাড়াতে র্যাফেল ড্র, শপিংমলের সামনে আলোকসজ্জা সব কিছুই এবার অনুপস্থিাত। আবার লকডাউনের জন্য মানুষের আগ্রহও কম দেখা গেছে কেনাকাটায়। ফলে, ঈদ তার রং হারিয়েছে অনেক আগেই। যেখানে রোজার সময় মসজিদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারাবির নামাজ পড়ার জন্য মুসল্লিদের ভিড় দেখা যেতো। এখন স্পর্শ বাঁচাতে সবাই দূরে দূরে। মানুষের স্পর্শ বাঁচাতেই শপিং মলগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় নেই। মানুষের জীবনযাত্রা একেবারেই ওলটপালট করে দিয়েছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। কামরুল আনাম নান্নু প্রতি বছর ঈদে সপরিবারে ঈদে বাড়ি যান। তিনি জানালেন, ২০০০ সাল থেকে ঢাকায় তারা দুই ভাই থাকেন। প্রতি বছর দুই ঈদেই ভাই, স্ত্রী, বাচ্চা সবাইকে নিয়ে বাড়ি যান তারা। অন্য দুই ভাই চাকরি করেন ভিন্ন জেলায়। তারাও চলে আসে। ঈদকে ঘিরে পারিবারিক মিলনমেলা বসে বাড়িতে। এবার তা হচ্ছে না। এবারের ঈদ তাই হয়ে উঠবে অনেকটাই ভার্চুয়াল ঈদ উদ্যাপন। চাকরি বা ব্যবসার কারণে যে যেখানে থাকে সেখানেই এবারের ঈদ। সেই ঈদও কাটবে বাড়ির চার দেয়ালের ভেতরেই। সবাই ঈদের দিন সেল ফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও কল করেই সারবেন ঈদে প্রিয়জনের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পালা। কিংবা অনলাইন প্লাটফর্ম জুমে চলবে গ্রুপ আড্ডা। করোনাকাল আমাদের ঘরবন্দি করে দিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে বাড়ি না যেতে পারার কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে। দেখা হবে ভিডিও কলে। করোনাকালে এতেই খুঁজে নিতে হবে ঈদের আনন্দ।
এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার সারাদেশে ঈদের নামাজের জামাত খোলা ময়দানে না করে শুধুমাত্র মসজিদে আদায় করার জন্য সরকারি নির্দেশনার কারণে ঈদ আনন্দ আরও খানিকটা ম্লান হয়ে গেছে। কেননা ইসলামী শরীয়তে ঈদগাহ বা খোলা জায়গায় পবিত্র ঈদুল-ফিতরের নামাজের জামাত আদায়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে প্রধানত ঈদগাহেই ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এছাড়া এবার শিশু, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তি এবং তাদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে ঈদের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ না করার এবং জামাত শেষে কোলাকুলি এবং পরস্পর হাত মেলানো পরিহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ফলে ঈদের জামাত ঘিরে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের মাঝে যে আনন্দের শ্রোতধারা বয়ে যায়, তাতেও ভাটা পড়েছে। অন্যদিকে সারদেশে অঘোষিত লকডাউন এবং বাস ট্রেন-লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় শহরের কর্মস্থল থেকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ফিরতে পারেনি। প্রবাসীদের কাছ থেকে আসেনি আত্মীয়-স্বজনদের জন্য ঈদ খরচার অর্থ। বেতন-বোনাস হয়নি চাকরিজীবী অনেকের; কেউবা করোনা পরিস্থিতির এই দুঃসময়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন; কর্মহীন হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ পেশাজীবী মানুষ। অনেকের ঘরে করোনায় সংক্রমিত অসুস্থ রোগী; কারো স্বজন মৃত্যু যন্ত্রণায় হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ রয়েছে হোম কোয়ারেন্টিন ও প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে। এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অতি সম্প্রতি অনেকের ভাই-বোন-মা-বাবাসহ নিকটাত্মীয়-স্বজন মারা গেছেন। এসব পরিবারে ঈদ আনন্দ অনেকটা নিরানন্দে রূপ নিয়েছে।
এর উপর ঈদের ঠিক আগমুহূর্তে সুপার সাইক্লোন আম্পানের তান্ডব দেশের উপকূল এলাকার জনজীবন লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। ২৭ রমজানের রাতে বয়ে যাওয়া এ ঘূর্ণিঝড়ে সন্দ্বীপ, খুলনা, যশোর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা ও সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ঝিনাইদহসহ বেশকিছু জেলায় জানমাল, ফসল ও বসতভিটার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় সেখানের মানুষের ঈদ আনন্দ পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে। ঈদের উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতির পরিবর্তে সেখানকার মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত, ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ সংস্কার ও পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া ফসলের ক্ষেত উদ্ধারে দিন পার করতে হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ে শিশু সন্তানসহ প্রিয়জনের মৃত্যুতে অনেক পরিবারে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে শোকের মাতম চলছে। তবে এ কঠিন দুঃসময়ের মাঝেও অনেকে পরিবারের শিশু সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে ঈদ আনন্দকে কিছুটা হলেও জিইয়ে রাখার প্রাণবন্ত চেষ্টা চালিয়েছেন। করোনা সংক্রমণের ভীতি ও আর্থিক দৈন্যতা উপেক্ষা করে অনেকে পরিবারের অন্যান্য বাজেট কিছুটা কাটছাঁট করে শিশু-সন্তানদের জন্য নতুন পোশাক কিনেছেন। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীদের দাওয়া দিতে না পারলেও ঈদের দিন পরিবারের সদস্যরা যাতে ভালো কিছু খেতে পারে এজন্য অনেকে কমবেশি সেমাই, পোলাওয়ের চাল, মাংস কিনেছেন। কেউ কেউ এসব খাদ্যদ্রব্য কিনে গরিব আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়েছেন। সামর্থ্যবানরা অনেকে ঈদ উপলক্ষে নতুন জামা-কাপড় না কিনে সে টাকায় বিভিন্ন উপহারসামগ্রী কিনে দুস্থ অসহায় মানুষের মাঝে বিলিয়ে আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সরকারিভাবেই নিম্নবিত্তের মাঝে ঈদ উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে প্রতিবছর ঈদের আগে গ্রামীণ অর্থনীতি যেভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠে, এবার দেশের কোথাও সে চিত্রের দেখা মেলেনি। গ্রামের হাটে-ঘাটে ঈদ কেনাকাটা একরকম হয়নি বললেই চলে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৫ রোজার পর থেকেই গ্রামের মানুষের কাছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পাশাপাশি শহরে চাকরিজীবী বাবা-মা, ভাইবোনসহ নিকটাত্মীয়-স্বজনদের বেতন বোনাসের টাকা আসতে শুরু করে। সে টাকায় নতুন কাপড়-চোপড়, মিষ্টান্ন, সেমাই, পোলাওয়ের চাল ও মাংসসহ নানা উপাদেয় খাবার কেনার ধুম পড়ে যায়। এছাড়া ঈদের আগে শহর থেকে কর্মজীবী স্বামী-সন্তান গ্রামে ফিরে এলে তাদের কী খাওয়ানো হবে তার প্রস্তুতিতে কর্মচাঞ্চল্য বাড়ে প্রতিটি পরিবারে। অথচ করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার এসব প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও নেই বরাবরের মতো ঈদের আমেজ। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে বেশির ভাগ মানুষ ঈদ কেনাকাটা করতে মার্কেটে-মার্কেটে ঢু মারেনি। সীমিত সংখ্যক মানুষ মার্কেটে ঘুরে কেনাকাটা করলেও সামর্থ্যবানদের বেশিরভাগই অনলাইনে শপিং করেছেন। ফলে মার্কেট, বিপণিবিতান ও শপিংমলগুলোতে ঈদ কেনাকাটায় ছিলো চরম মন্দা। দোকান মালিকদের ভাষ্য, ১০ মে থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত স্বল্পদিনের বেচাবিক্রিতে মোটা লাভ দূরে থাক, অনেকে দোকান কর্মচারীদের বেতনও ঠিকমতো তুলতে পারেননি। এদিকে গত কয়েকদিন আগ পর্যন্তও মাইক্রোবাসসহ ভাড়ার বিভিন্ন গাড়িতে বিভিন্ন গন্তব্যে নির্বিঘ্নে যাতায়াতের সুযোগ থাকায় চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের অনেকে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। কাজকর্ম শেষে ঈদের এক-দুদিন আগে তারা গ্রামে ফিরবেন এমন প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। অথচ শেষ সময়ে যান চলাচলের উপর আকস্মিক কড়াকড়ি আরোপ হওয়ায় তারা গ্রামে ফিরতে পারেননি। ফলে পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের ঈদ আনন্দ বিষাদের কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে। তবে করোনা মহামারির এ দুর্যোগের মাঝেও দেশের প্রতিটি কারাগার, এতিমখানা, সরকারি শিশুসদন, ছোটমণি নিবাস, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, আশ্রয়কেন্দ্র, বৃদ্ধাশ্রম এবং ভবঘুরে ও দুস্থ কল্যাণকেন্দ্রে ঈদের দিন উন্নতমানের খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে তাদের খাবারের তালিকায় সেমাইয়ের সঙ্গে ফিরনি, পায়েস, পোলাও-কোরমাসহ অন্যান্য সুস্বাদু খাবার থাকবে। তবে প্রতিবছর ঈদ উপলক্ষে বড় শহর ও রাজধানীর বিনোদনকেন্দ্রগুলো উৎসবের রূপে সাজলেও এবার সে চিত্র পুরোপুরিই উল্টো। চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, শিশুপার্কসহ প্রায় সব বিনোদনকেন্দ্রগুলোতেই খাঁ খাঁ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ