চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে মণ্ডপে মণ্ডপে ভক্তবৃন্দের উপচে পড়া ভিড়

সপ্তমীর সন্ধ্যায় দেবী দর্শনে উপচেপড়া ভিড় আজ কুমারী ও সন্ধিপূজায় মুখর হবে মন্দির প্রাঙ্গণ

স্টাফ রিপোর্টার: ধূপের ধোঁয়া, ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ, কাঁসর ও উলুধ্বনিতে মুখর এখন দেশের দুর্গামন্ডপ প্রাঙ্গণ। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নয়, মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে শারদীয় দুর্গোৎসবে অংশ নিচ্ছেন অন্যরাও। শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাসপ্তমী উদযাপিত হয়েছে গতকাল শনিবার। এইদিন ভোরে দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, ঢাক-ঢোল কাঁসর বাজিয়ে, চন্ডিপাঠের মাধ্যমে সপ্তমীবিহিত পূজা হয়। আজ রোববার মহাষ্টমী। সকালে দুর্গা দেবীর মহাষ্টমীবিহিত পূজা, ব্রতোপবাস ও পুষ্পাঞ্জলি এবং মহাষ্টমীর আকর্ষণ কুমারী পূজা ও সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হবে। অষ্টমী তিথি শেষ হবে আজ সন্ধ্যা ৭টা ৫৮ মিনিটে। এ সময়ের মধ্যেই পূজা-আচারদি শেষ করতে হবে। চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে গতকাল শনিবার মহাসপ্তমীর দিনে সকাল থেকে পূজামন্ডপগুলোতে মানুষের ঢল নামে। বিকেলের দিকে দর্শনার্থী বাড়তে থাকে। আজ মহাষ্টমীতে দর্শনার্থী আরও বাড়বে বলে মনে করছেন আয়োজকরা। আগামীকাল মহানবমী ও মঙ্গলবার বিজয়া দশমীর দিনে প্রতিমা নিরঞ্জনের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব শেষ হবে।
শাস্ত্রমতে, দেবীকে আসন, বস্ত্র, পুষ্পমাল্য এ ধরনের ষোল উপাদান (ষোড়শ উপাচার) দিয়ে মহাঅষ্টমীর পূজা-অর্চনা করা হয়। ভোরে ত্রিনয়নী দেবীর চক্ষুদান করা হয়। পূজা-অর্চনা শেষে দেবীর কৃপালাভের আশায় তার চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেন ভক্তরা। এজন্য মন্দিরগুলোয় উপবাসী পূজারি এবং ভক্ত-দর্শনার্থীর ঢল নামবে। ভক্তরা নতুন কাপড় পরে বাহারি সাজে মন্দিরে-মন্দিরে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে শরণাগত হবেন। পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে গভীর রাত পর্যন্ত চলবে প্রতিমা দর্শন। মহাষ্টমী উপলক্ষে বিভিন্ন মন্ডপে আয়োজন করা হয়েছে ভক্তিমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির। বিশুদ্ধ পঞ্জিকা অনুসারে, মহাঅষ্টমীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে এবং বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে কুমারী পূজা। দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে অষ্টমীবিহিত পূজা সমাপনের পর। মহাদুর্গাষ্টমী ও মহাদুর্গানবমীর সন্ধিক্ষণে বিকাল ৫টা ২৩ মিনিটে অনুষ্ঠিত হবে সন্ধিপূজা। এই পূজা সমাপন হবে বিকাল ৬টা ১১ মিনিটের মধ্যে। সন্ধি কথার অর্থ মিলন। মহাষ্টমী ও মহানবমী তিথির মহামিলনের সময়কে বলা হয় মহাসন্ধিক্ষণ। অসুর শক্তি বিনাশের লক্ষ্য নিয়ে এ সময় সন্ধিপূজা হয়। ধর্মীয় ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে অসুর শক্তি বিনাশের জন্য ‘প্রতীকী বলি’ও কার্যকর করা হবে কোনো কোনো মন্দিরে। সন্ধিপূজা শেষে সন্ধ্যায় মন্দির-মন্ডপে আরতি, কীর্তন ও ভক্তিমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন ভক্তরা। আজও ঢাকের বাদ্য, উলুধ্বনি, শঙ্খ ও কাঁসরের ধ্বনিতে মুখরিত হবে মন্ডপ প্রাঙ্গণ। পূজা শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হবে আগত ভক্ত-দর্শনার্থীদের মধ্যে। আগামীকাল সোমবার উৎসবের চতুর্থ দিনে দেবীর মহানবমীবিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপকমিটির সদস্য এবং চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশী দিলীপ কুমার আগরওয়ালা চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গার ১২টি পূজামন্ডপ পরিদর্শন করেছেন। গতকাল শনিবার সন্ধ্যার পর জামজামি ইউনিয়নের কর্মীসভা শেষে প্রথমে জামজামি বাজারের পূজামন্ডপ পরিদর্শন করেন তিনি। এরপর আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার রথতলা, ক্যানাল পাড়া, বাবুপাড়া, গোবিন্দপুর ও স্টেশনপাড়া পূজামন্ডপ পরিদর্শন করেন ও উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। এরপর জেহালার মুন্সীগঞ্জ পূজামন্ডপ ও পরে রাতে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার তালতলা, দাসপাড়া ও বড় বাজার পূজামন্ডপ পরিদর্শন করেন ও পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন।
দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে দামুড়হুদার বিভিন্ন পূজাম-প পরিদর্শন করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমা। গতকাল শনিবার দুপুরে তিনি দামুড়হুদা উপজেলার সদরের বিভিন্ন পূজাম-প পরিদর্শন করেন। পূজাম-প পরিদর্শনকালে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য বাঙালি জাতি লড়াই-সংগ্রাম করেছে। একটি উন্নত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকতার সহিত দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা এড়াতে প্রতিটি পূজাম-পে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকরাও কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান তিনি। পূজাম-পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে পর্যাপ্ত পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। এছাড়া আনসার বাহিনীকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি সবাইকে গুজবে কান না দিয়ে কোনোকিছু নজরে এলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর আহ্বান জানান। এসময় উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল-মামুন, এনএসআই’র উপ-পরিচালক ইয়াছিন সোহাইল, দামুড়হুদা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সজল কুমার দাস, সহকারী পুলিশ সুপার জাকিয়া সুলতানা, দামুড়হুদা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর কবির, দামুড়হুদা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হযরত আলী, দামুড়হুদা উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি উত্তম রঞ্জন দেবনাথ। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন দামুড়হুদা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক তৌহিদুর রহমান তৌহিদ, দামুড়হুদা সদর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নুরুল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, মতিয়ার রহমান, যুবলীগনেতা ইকরামুল হোসেন প্রমুখ।
দর্শনা অফিস জানিয়েছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপুজার মহাষষ্ঠির দিন দর্শনার লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন বাউল পরিষদের শিল্পীদের পরিবেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে ‘বেহুলা লক্ষ্মিন্দরের’ পালা। দর্শনা আদিবাসী কালিদাসপুর দুর্গামাতা মন্দিরের সামনে শনিবার মহাষষ্ঠির রাত নয়টার দিকে এ পালাটি শুরু হলেও শেষ হয় ভোরে। দামুড়হুদা উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি শ্রী উত্তম রঞ্জন দেবনাথ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উপস্থিত ছিলেন কালিদাসপুর মন্দির কমিটির সভাপতি শ্রী শ্যামল দাস, সম্পাদক শঙ্কর দাস প্রমুখ। পালা, মিউজিক ও সার্বিক অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোকসংগীত শিল্পী ধীরু বাউল। ধীরু বাউল জানান, গ্রাম বাংলার আদি ও অকৃত্তিম ঐতিহ্যবাহী লোকজ পালা সুষ্ঠু পরিবেশনে পরিচালিত হলে সহজ সরল মানুষ তা দেখে শুনে মুগ্ধ হবে। লোকজ ঘরানার সুর সংগীত পালা ও প্রায় হারিয়ে যাওয়া লোকজ খেলাধুলা বেশী বেশী আয়োজনের করা দরকার।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার মহাসপ্তমী ছিল গতকাল শনিবার। এদিন সকাল সকাল থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে উচ্চারিত হচ্ছিল পুরোহিতের মন্ত্রধ্বনি। মহাসপ্তমীতে দেবীকে আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, পুষ্পমাল্য, চন্দন, ধূপ ও দীপ দিয়ে পূজা করেন ভক্তরা। এসময় পূজারিরা প্রতিমার সামনে বসে মায়ের মুখ দর্শন করেন। পরে পুষ্পাঞ্জলির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় মহাসপ্তমীর পূজা।
সনাতনী শাস্ত্র অনুযায়ী এবার দেবী দুর্গার আগমন ঘোটকে অর্থাৎ ঘোড়ায়। শাস্ত্রমতে যার ফল খুব একটা শুভ না। শাস্ত্র অনুযায়ী দেবীর ঘোড়ায় আগমন ছত্রভঙ্গের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া দেবীর গমনও এবার ঘোটকে। যার ফলও শুভ বার্তা দিচ্ছে না। শাস্ত্রমতে, দুর্গা যদি ঘোটকে চড়ে আসেন এবং বিদায় নেন তবে তার ফল ‘ছত্র ভঙ্গ স্তুরঙ্গমে’ অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক ও যুদ্ধ সংক্রান্ত অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। এরফলে দুই দেশে যুদ্ধ হতে পারে। সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে ধ্বংস ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এক কথায় একে বলা হয় ‘ছত্রভঙ্গম’।
আন্দুলবাড়িয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মহাসপ্তমীতে জীবননগর উপজেলার ২৭টি সর্বজনীন শারদীয় দুর্গা মন্দির পরিদর্শন করলেন উপজেলা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও পূজা উদযাপন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির নেতৃবৃন্দ। গতকাল শনিবার সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে দিনভর মন্দির পরিদর্শন করেন উপজেলা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রমেন বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক সাগর বিশ্বাস, উপজেলা পূজা উদযাপন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক সাংবাদিক নারায়ণ ভৌমিক, সদস্য সচিব জীবননগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যাদব কুমার প্রামানিক, সাবেক সভাপতি বিজয় হালদার নেতৃত্বে সদস্য পষ্কজ দত্ত, সুশান্ত সাহা, হিরু সান্তরা, সহদেব বিষ¦াস, স্বপন হালদার, সন্তোষ কর্মকার, সুকুমার বিশ্বাস, গোপল সাতরা, গৌর ঘোষ, স্বপন প্রামানিক, অনন্ত পাল, বসুদেব রক্ষিত, স্বরজিৎ কর্মকার, বিষ্ণু কুমার বিশ্বাস, রাম চন্দ্র রাজবংশী, প্রল্লাদ বিশ্বাস, নিমাই কুমার দাস ও স্বপন কুমার দাস পরিদর্শন দলে উপস্থিত ছিলেন। নেতৃবৃন্দ উৎসবমুখর পরিবেশে দৌলতগঞ্জ শ্রীশ্রী সিদ্বেশ্বরী কালি মন্দির, জীবননগর সর্বজনীন দুর্গা মন্দির, সুবলপুর দুর্গা মন্ডপ, সীমান্ত ইউনিয়নের শাখারিয়া শিবকালি মন্দির, শাখারিয়া দুর্গা পূজা ম-প, পেয়ারাতলা লক্ষ্মী নারায়ণ পূজা ম-প, মনোহরপুর পালপাড়া দুর্গা মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির আদিবাসীপাড়া শ্রী শ্রী কৃষ্ণ মন্দির, সিংনগর হালদারপাড়া পূজা ম-প, শিয়ালমারী আদিবাসীপাড়া দুর্গা মন্দির, সেনেরহুদা দাসপাড়া পূজা মন্ডপ, উথলী দাসপাড়া সর্বজনীন দুর্গা মন্দির, কর্মকারপাড়া সর্বজনীন দুর্গা মন্দির, দেহাটি পালপাড়া দুর্গা মন্দির, অন্নপূর্না পূজা মন্ডপ, কাশিপুর হালদারপাড়া পূজা মন্ডপ, সুটিয়া মহাদেব পূজা মন্ডপ, পাথিলা দুর্গা মন্ডপ, মাধবপুর দুর্গা পূজা মন্ডপ, হাসাদাহ মুক্তিপাড়া দুর্গা পূজামন্ডপ, বকুন্ডিয়া দুর্গাপূজা মন্ডপ, রায়পুর কালি মন্দির, দুর্গাপূজা মন্ডপ, বারুইপাড়া দুর্গা পুজা মন্দির, কামারপাড়া দুর্গা মন্দির, বাজদিয়া সরদারপাড়া দুর্গা মন্দির ও নিশ্চিন্তপুর হালদারপাড়া দুর্গা মন্দির পরিদর্শন করেন ও স্ব স্ব মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে নগদ অর্থ ও সেচ্ছাসেবকদের মাঝে উপহার হিসাবে গেঞ্জি তুলে দেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More