আফজালুল হক: চুয়াডাঙ্গায় করোনাভাইরাস সংক্রমণে বাড়ার সাথে সাথে সদর হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ডাক্তার ও সেবিকাদের। ইতিমধ্যে হাসপাতালে অক্সিজেন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তবে এই সঙ্কট কাটাতে চুয়াডাঙ্গাবাসীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন একদল উদ্যোম তরুণ। ঠিক রাত ১২টা। সংযোগের চুয়াডাঙ্গার কর্মরতদের নিকট ফোন আসলো, চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার আইলহাস গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ ঠা-ু মিয়ার হঠাৎই তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে ছটফট করছেন। অক্সিজেন স্যাচুরেশন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। এ অবস্থায় জরুরি অক্সিজেনের প্রয়োজন তার। প্রত্যন্ত গ্রাম, এ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া প্রায় অসম্ভব। তখন সংযোগ-কানেকটিং পিপল এর চুয়াডাঙ্গা হাবের হেল্প লাইন নাম্বারে কল দিলো রোগীর স্বজনেরা। রিং বাজতেই সংযোগের চুয়াডাঙ্গা ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের সদস্য আসিম রিং ধরেই রোগীর শারীরিক অবস্থা ও অবস্থান জেনে নিয়ে রোগীকে সংযোগ এর মেডিকেল টিমের চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলো।
মেডিকেল টিম থেকে কনফার্মেশন শেষে, সংযোগের চুয়াডাঙ্গা সংযোজক সিয়াম ও ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের সদস্য আসিম অক্সিজেন সিলিন্ডার, রেগুলেটর, ন্যাসাল ক্যানোলাসহ বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যে। চুয়াডাঙ্গা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার এর পথ। পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো বৃষ্টি। বাধা উপেক্ষা করে ছুটে চললো-সংযোগের চুয়াডাঙ্গা হাবের সদস্যরা। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল রোগীর বাসায়। অক্সিজেন পেয়ে বৃদ্ধ বাবার স্বস্তি ফিরলো। রোগীর স্বজনদের হৃদয়েও বয়ে গেলো প্রশান্তির শীতল বাতাস। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন জাহানারা বেগম নামের একজন বৃদ্ধা মা। চুয়াডাঙ্গার পাঁচমাইল গ্রামের সেই মায়ের আক্রান্ত হয়েছে ফুসফুরের প্রায় ৪০ শতাংশ। প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগছেন তিনি। রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার মতও অবস্থায়ও নেই। দ্রুতই জাহানারা বেগমের সন্তান ফোন দিলেন সংযোগের চুয়াডাঙ্গা হাবের হেল্পলাইন নাম্বারে। কল পেয়ে প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যেই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে পৌঁছে দিলো রোগীর বাসায় সংযোগের চুয়াডাঙ্গা হাবের সদস্য নাঈম, তানজিল এবং আবীর। ৩০ মে সংযোগের জরুরি অক্সিজেন সেবা কার্যক্রমে যুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা জেলা। সেই থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে একমাস ধরে চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, দর্শনা, জীবননগরসহ প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে জরুরি মুহূর্তে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছে সংযোগের কর্মীরা। সংযোগের জরুরি অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম বাংলাদেশের প্রায় ৩৫টি জেলাতে চলমান রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা হাবের কার্যক্রম সংযোজক হিসাবে দিন রাত ২৪ ঘন্টা কাজ করে যাচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সিয়াম। এছাড়াও সংযুক্ত আছে আসিমুজ্জামান, নাঈম, তানজিল, আবীর, রাজনসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীরা। নিরলস আর নির্ভিক তাদের ছুটে চলা। চুয়াডাঙ্গা হাবের সমন্বয়কারী সংযোজক শাহরিয়ার সিয়াম বলেন, করোনার এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে ‘শ্বাস কষ্টে থাকবেনা বাংলাদেশ’ এই সেøাগানকে সামনে রেখে চলছে সংযোগের চুয়াডাঙ্গা হাবের জরুরি অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম। ৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে চুয়াডাঙ্গা হাবের যাত্রা শুরু। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গাতে করোনা পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারণ করলে সংযোগের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী আহমেদ জাভেদ জামালের নির্দেশনায় পর্যায়ক্রমে আরো ২৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার যুক্ত হয়েছে। চুয়াডাঙ্গাতে এক মাসে প্রায় ৪০ জনের অধিক রোগীকে সংযোগের জরুরি অক্সিজেন সেবা দেয়া হয়েছে। প্রায় ৬০ এর অধিক সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়া হয়েছে রোগীর বাসায়। সাধারণত বাসায় কোনো করোনা রোগী থাকলে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র প্রদর্শনপূর্বক তাকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দেয়া হয়েছে প্রায় ১৫ জন রোগীকে। দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে এই সেবাটি সরবরাহ করছে সংযোগ। তবে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল রোগীদের জন্য একটি ন্যূনতম সার্ভিস চার্জ নেয়া হচ্ছে, যেটা দিয়ে অক্সিজেন ও সিলিন্ডার সংগ্রহ, সিলিন্ডার স্যানিটাইজ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। তিনি আরও বলেন, এমনও দিন আছে খাওয়ার সময় পর্যন্ত পাই না। ইতিমধ্যে অক্সিজেনের চাহিদা ব্যপক বেড়েছে। আমাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমনকি বেশির ভাগ অক্সিজেনের জন্য সদর হাসপাতালের রোগীরা ফোন করেন। এভাবেই এই মহামারির সময়ে মানব সেবাই কাজ করে যেতে চাই। সংযোগ জরুরী অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম ছাড়াও সংযোগের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে রক্তদান ,স্বাবলম্বীকরণ, দূর্যোগকালীন সেবা, টেলিমেডিসিন, মেডিকেল সাপোর্ট, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, কেয়ারগিভার সেবাসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সংযোগ। গত বছর করোনার শুরুর দিকে যাত্রা শুরু হয় সংযোগ কানেকটিং পিপল নামের এই সংগঠনের। প্রথমদিকে সংযোগের কার্যক্রম ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশের ৩৫ জেলায় তাদের কার্যক্রম চলছে।প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জেলায় সংযোগের হাব চালু হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা হাবের সংযোজক শাহরিয়ার সিয়াম (০১৭৫৭৫৬৮৬৫১) ও আসিমুজ্জামানের ( ০১৫১৭৮০৯৮৩৩) এর নম্বারে কল দিলেই পৌঁছে যাবে অক্সিজেন সিলিন্ডার রোগীর বাসায়। সংযোগের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ জামাল দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, করোনা মহামারীর শুরু থেকেই করোনা রোগীদের বাসায় বাসায় অক্সিজেন ভর্তি সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়ার কাজটি শুরু করে সংযোগ। তখন চারিদিকে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরঞ্জামের সংকট থাকায় মাত্র ১২ টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে আমরা ঘরে ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়ার কাজটি শুরু করি। বর্তমানে দেশি বিদেশি ডোনারের সহযোগিতায় ৪৫০ এর অধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ১৫ এর অধিক অক্সিজেন কনসেনট্রেটর দিয়ে ৩৫টি জেলায় জরুরি অক্সিজেন সেবা দিয়ে যাচ্ছে সংযোগ কানেকটিং পিপল।
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ