স্টাফ রিপোর্টার: পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ফ্যামিলি কার্ড নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার ৭, ৮, ৯ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেফালী খাতুনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেয়া হয়েছে। একজন মৃত নারীসহ ৫০ জনের নামে দুটি করে কার্ড তৈরি ও একাধিকবার পণ্য উত্তোলনের ঘটনায় ওই নোটিশ দেয়া হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেফালি খাতুনকে লিখিতভাবে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম ভূইয়া। তিন কার্যদিবসের মধ্যে ওই নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে। নোটিশের অনুলিপি দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসককে।
কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়েছে, ‘ঈদুল আজহা উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সংরক্ষিত ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে টিসিবির পণ্য আপনার স্বাক্ষরিত ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে ৪৯ জন ব্যক্তির নামে দুটি করে কার্ড এবং মৃত ব্যক্তির নামে একাধিক কার্ড ইস্যু করে ক্ষমতার ব্যবহার করেছেন মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যেহেতু আপনার এ ধরনের কার্যকলাপ স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯-এর ৩২ (ঘ) ধারা অনুযায়ী অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের শামিল, সুতরাং ওই আইনে আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা কেনো গ্রহণ করা হবে না, তা নোটিশ পাওয়ার তিন কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হলো। এই চিঠি পৌর মেয়র কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে জারি করা হলো।’
অভিযোগ রয়েছে, যেখানে একটি পরিবার একটি মাত্র ফ্যামিলি কার্ড পাবে সেখানে একাধিক স্বচ্ছল ব্যক্তির নামে দুটি করে ফ্যামিলি কার্ড দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ফ্যামিলি কার্ড পেয়েছেন মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীরাও। আবার একই পরিবারের ৩ জনকেও দেয়া হয়েছে ওই কার্ড। প্রতিটি ফ্যামিলি কার্ডে সংরক্ষিত ওই নারী কাউন্সিলরের স্বাক্ষর ও সিল রয়েছে। বুধবার সকালে টিসিবির পণ্য বিতরণের পর বিষয়টি জানাজানি হলে চুয়াডাঙ্গা শহরজুড়ে শুরু হয় নানা সমালোচনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলরদের মাধ্যমে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করা হয়। বুধবার কার্ডধারীদের মধ্যে টিসিবির পণ্য বিতরণ শুরু হয়েছে। মোট ৪০৫ টাকার বিনিময়ে দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি মসুর ডাল ও এক কেজি করে চিনি বিতরণ করা হচ্ছে। সে হিসেবে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১১০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা এবং প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় সংরক্ষিত ওয়ার্ডের তিনজন নারী কাউন্সিলরের প্রত্যেকের মাধ্যমে ৬০০ জন করে উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে। বুধবার পৌর এলাকার ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে সরকারি মূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রির সময় নানা অসংগতি ধরা পড়ে। ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্যানুযায়ী ৫০টি দ্বৈত কার্ডের সন্ধান মেলে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা এলাকার ৯নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গোরস্থান পাড়ার রবিসন নেছা। গত ৩ মাস আগে তিনি মারা গেলেও তার নামে দেয়া হয়েছে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড। মৃত রবিসনের নামে এর আগেও দুইবার টিসিবির পণ্য কেনা হয়েছে।
একই ওয়ার্ডের গোরস্থানপাড়ার মোতাহার হোসেন, তার দুই ছেলে সৈয়দ মো. পারভেজ হোসেন ও সৈয়দ মো. মুরাদ হোসেনকে ফ্যামিলি কার্ড দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকের রয়েছে দুটি করে কার্ড। যার মধ্যে সৈয়দ মো. মুরাদ হোসেনের (তিনি গত ৫-৬ বছর ধরে কুয়েতে অবস্থান করছেন) নতুন ও পুরাতন ছবি দিয়ে ফ্যামিলি কার্ড করে দেয়া হয়েছে। পারভেজ হোসেনের একটি কার্ডে ছবি থাকলেও আরেকটি কার্ড ছবি ছাড়া। একটি কার্ডের সাথে আরেকটি কার্ডের মোবাইল নম্বর একই দেয়া হয়েছে। একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা হাসনা জাহানের নামেও দুটি ফ্যামিলি কার্ড পাওয়া গেছে। কার্ডে দেয়া মোবাইল নম্বর একই। তবে, দুই কার্ডে ব্যবহার করা হয়েছে দুই রকম ছবি। ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোছা. তাহমিনা খাতুনের নামেও একই রকম ছবি সংযুক্ত দুট ফ্যামিলি কার্ড পাওয়া গেছে। এমন আরও ৪৪টি কার্ডের ছবি এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। তাদের প্রত্যেকের দুটি করে ফ্যামিলি কার্ড রয়েছে। শুধু তাই নয়, যে ব্যক্তিদের নামে কার্ড আছে তারা পূর্বেও টিবিবির পণ্য ক্রয় করেছেন। প্রতিটি ফ্যামিলি কার্ডে ৭, ৮, ৯ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেফালী খাতুনের স্বাক্ষর ও সিল রয়েছে।
তবে কাউন্সিলর শেফালী খাতুন তার বিরুদ্ধে আনা অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমি ওই ধরণের কাজ করিনি। আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হচ্ছে। তার দাবি, রবিছন নেছা বেঁচে থাকাকালেই তার নামে কার্ড তৈরি করা হয়েছিলো। রবিছনের পরিবারের সদস্যরা তার পক্ষে পণ্য কিনেছেন। তবে, অসাবধানতাবশত কিছু লোকের নামে একাধিক কার্ড তৈরি হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম ভূইয়া বলেন, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর শেফালী খাতুনের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। কাউন্সিলর শেফালী খাতুন মুসলিমপাড়ার বাসিন্দা মৃত রবিছন নেছাসহ ৫০ জনের নামে দুটি করে কার্ড তৈরি করেছেন। এসব কার্ডের বিপরীতে সরকারিভাবে দুই ঈদের আগে দুই দফা পণ্য বিক্রি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এসব জালিয়াতির দায় শেফালী খাতুন কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারেন না। কারণ, প্রতিটি কার্ড শেফালী খাতুন নিজে তৈরি করেছেন এবং কার্ডগুলোতে তার সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে। এ জন্য তাকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে ওই নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হলে তার কাউন্সিলর পদ বাতিলের জন্য সুপারিশ করা হবে।