সার ডিলারদের কাছে জিম্মি কৃষকরা ॥ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় সারের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন ডিলাররা। কৃষকদের কাছ থেকে সারের দাম ২-৩ টাকা করে কেজিতে বেশি নেয়া হচ্ছে। কৃষকরা মাঠে আমন ধান ও আগাম সবজি চাষ করছেন। আর আগামী মাস থেকে ভুট্টার চাষ শুরু হবে। এ সুযোগে সার ডিলাররা বেশি মুনাফার আশায় সারের সঙ্কট তৈরি করছেন বলে কৃষকদের অভিযোগ।
কৃষকরা জানিয়েছেন, ডিলারদের কাছে সার কিনতে গেলে বলছেন সার নেই। অন্য জায়গা থেকে এনে দিতে হবে তাই বস্তা প্রতি ১শ-২শ টাকা বেশি দিতে হবে। সারের কৃত্রিম সঙ্কট ও দাম বেশি হওয়ার কারণে চাষ ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষক। জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, কৃষকদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিলেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে ডিলারশিপ বাতিল করা হবে। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখা নিজেদের পক্ষেই সাফাই গাইলেন।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসূত্রে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত মূল্যে ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয় ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি এবং ডিএপি সার। ইউরিয়া সার বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৬ টাকা, টিএসপি ২২ টাকা, এমওপি ১৫ টাকা এবং ডিএপি ১৬ টাকা। কৃষকরা এখন মাঠে আমন ধান, আগাম ফুলকপি, পাতাকপি, শসা, করোলা, লাউসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ করছেন। আর আগামী মাস থেকে ভুট্টা চাষ শুরু হবে। চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলা এ মৌসুমে আমন ধান চাষ করছেন কৃষকরা ৩২ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে। আগাম সবজি চাষ হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। আর ভুট্টার চাষ হবে জেলায় এ মৌসুমে ৪৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। যা দেশের সর্বোচ্চ ভুট্টার আবাদ হবে জেলায়। চুয়াডাঙ্গা জেলায় বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের ডিলার রয়েছেন ৫০ জন ও বিএডিসির ডিলার রয়েছেন ৫৯ জন। বিএডিসির ২ জন ডিলার তাদের লাইসেন্স নবায়ন না করায় বাতিল করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গায় ইউরিয়া সার মজুদ রয়েছে ডিলারদের কাছে ১ হাজার ৩২৫ মেট্রিক টন, টিএসপি ৪৫১ মেট্রিক টন, এমওপি ৪৮৮ মেট্রিক টন ও ডিএপি ৫৩৫ মেট্রিক টন। সেপ্টেম্বর মাসে ডিলারদের সার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ইউরিয়া ৩ হাজার ১০৩ মেট্রিক টন, টিএসপি ৫৮০ মেট্রিক টন, এমওপি ৮৩৯ মেট্রিক টন ও ডিএপি ১৩৭৪ মেটিক টন। সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ডিলার সার উত্তোলনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। শুধু ৮৩৫ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উত্তোলন করেছেন ডিলাররা। অন্য সার এখনও পর্যন্ত উত্তোলন করেননি।
এ সুযোগে অসাধু সার ডিলাররা কৃত্রিমভাবে সার সঙ্কট তৈরি করছেন। তারা কৃষকদের কাছ থেকে বস্তা প্রতি ১শ-২শ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছেন। কৃষকদের বলছেন সার কম আছে তাই দাম পড়বে বেশি। কারণ অন্য জায়গা থেকে সার নিয়ে আসতে হবে। সার বিক্রির সময় কৃষকদের কোনো ভাউচার দেয়া হচ্ছে না, কারণ দাম বেশি নিচ্ছেন। ডিলাররা নিজেদের খাতায় সঠিক দামে বিক্রির হিসাব লিপিবদ্ধ করে রাখছেন। সারের কৃত্রিম সঙ্কট অব্যাহত থাকলে কৃষকদের চাষে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। ডিলারদের গোডাউনে সার মজুদ থাকলেও কৃষকরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ডিলাররা সারের দাম বেশি নেয়ার বিষয়ে প্রতিবাদ করলে কৃষকদের বলা হচ্ছে সার দেয়া হবে না। কোথায় সার পাও দেখি। সব ধরনের সার কেজি প্রতি ২-৩ টাকা করে বেশি নেয়া হচ্ছে। ডিলাররা সিন্ডিকেট তৈরি করে এ অবৈধ সুযোগ নিচ্ছে। যার ফলে কৃষকদের চাষে খরচ বেড়ে যাবে। গুনতে হবে লোকসান।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া, হানুরবাড়াদী, গাইদঘাট, আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়া, নাগদাহ গ্রামের কৃষক সোহেল, স্বাপন, রবিউল, রতন, আজমত আলী, জমির শেখ বলেন, সার ডিলাররা হঠাৎ করে এ মাসের শুরু থেকে সার নেই বলে টালবাহানা করছেন। কিন্তু বস্তা প্রতি ১শ-২শ টাকা বেশি দিলেই সার দিচ্ছে। রসিদ দেয় না সার কিনলে। টাকা বেশি নেয়ার বিষয়ে প্রতিবাদ করলে আর সার দেয়া হবে না বলে জানান ডিলাররা। বাধ্য হয়েই সার কিনতে হচ্ছে, কারণ চাষে সারের কোনো বিকল্প নেই। আমরা সার ডিলারদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। যারা অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
দামুড়হুদা উপজেলার পোতারপাড়া গ্রামের কৃষক উজ্জ্বল হক জানান, মাঠে আমার ধান ও শিম রয়েছে। প্রতি কেজি সারে ২ টাকা বেশি নিচ্ছে। সারের দাম বিক্রেতারা বেশি নিচ্ছে দেখার কেউ না থাকায় এটি হচ্ছে। কৃষকরা সার কিনতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছে বারবার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সার ডিলারের একজন ম্যানেজার বলেন, মালিক যেভাবে আমাদের নির্দেশ দেন সেইভাবে সার বিক্রি করতে হয়। আমাদের কিছু করার নেই। তারা সারের দাম নির্ধারণ করে দেয়। খাতায় দামের হিসাব ঠিক রাখা হলেও কৃষকের কাছে থেকে বাড়তি টাকা নেয়া হয়। চুয়াডাঙ্গা ডিঙ্গেদহ বাজারের বিসিআইসি সার ডিলার আনছার আলী বলেন, সারের সঙ্কট নেই। নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। সারের দাম বেশি নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আকবর আলী বলেন, সারের সঙ্কট নেই। এবার ভুট্টার আবাদ বেশি হবে বলে আমরা অতিরিক্ত সার বরাদ্দ চেয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কোনো ডিলার যদি সারের দাম বেশি নেন বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আলী হাসান বলেন, আমরা কিছু জায়গা থেকে জানতে পারছি কৃষকদের কাছ থেকে সারের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কৃষকদের সার নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সরকারি নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রি হবে। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে, আর কৃষক প্রতারিত হচ্ছে। তাহলে মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। বিষয়টি আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানিয়েছি।
জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে কৃষি জমিতে আবাদ করতে হবে। সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করছে। সারের কোনো সঙ্কট নেই। অতিরিক্ত মূল্যে সার বিক্রির অভিযোগ পেলে ডিলারশিপ বাতিল করা হবে।