স্টাফ রিপোর্টার: করোনায় নতুন করে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বিচারে বিশ্বের ২১৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এখন টপ টেনে (শীর্ষ দশে) রয়েছে। বিশ্বের করোনা পরিস্থিতির আপডেট তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডোমিটারের গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যান চিত্র পর্যালোচনায় এ হিসাব পাওয়া গেছে। এদিকে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যানুসারে সাজানো বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান মাত্র দেড় মাস আগে নিচের সারিতে থাকলেও তা এখন দ্রুত ধাপে ‘টপ টুয়েন্টির’ দিকে এগোচ্ছে। ২৮ মে করোনায় আক্রান্ত মোট ৪০ হাজার ৩২১ রোগী নিয়ে সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে ২২তম স্থানে রয়েছে। ২০ থেকে ২১তম তালিকায় থাকা কাতার ও নেদারল্যান্ডসে যথাক্রমে ৪৮ হাজার ৯৪৭ ও ৪৫ হাজার ৭৬৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ১ মে পর্যন্ত মোট ৮ হাজার ২৩১ জন রোগী নিয়ে বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ৪১তম, যা পরবর্তী দুই সপ্তাহে আরও ১১ ধাপ এগিয়ে গত ১৪ মে ৩০ তম অবস্থানে উঠে আসে। ওই দিন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ১৮ হাজার ৮৬৩ জন। অথচ এরপর মাত্র ১৪ দিনে অর্থাৎ ২৮ মে পর্যন্ত নতুন করে আরও ২১ হাজার ৪৫৮ জন রোগী বেড়ে বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশে অবস্থান এসে দাঁড়ায় ২২তম স্থানে। বিশ্বের করোনা পরিস্থিতির প্রতিদিনের আপডেট তথ্য প্রদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটির (ওয়ার্ল্ডোমিটার ডট ইনফো) পরিসংখ্যান চিত্রে দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত বিশ্বের ২১৫টি দেশের মধ্যে যে ২১টি দেশে মোট রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে, ওইসব দেশের মধ্যে ১৩টি দেশে ইতোমধ্যেই নতুন সংক্রমণের হার কমেছে। গত ২৫ মে এ তালিকার ৫ম অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যে নতুন করে ১ হাজার ৬২৫ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ অবস্থানে থাকা ইতালিতে ৩০০, ৭ম অবস্থানে থাকা ফ্রান্সে ৩৫৮, ৮ম অবস্থানে থাকা জার্মানিতে ৪৬১, ৯ম অবস্থানে থাকা তুর্কিতে ৯৮৭, ১৩তম অবস্থানে থাকা কানাডায় ১ হাজার ১২, ১৪তম অবস্থানে থাকা চীনে ১১, ১৮তম অবস্থানে থাকা বেলজিয়ামে ২৫০, ১৯তম অবস্থানে থাকা পাকিস্তানে ১ হাজার ৭৪৮, ২০তম অবস্থানে থাকা কাতারে ১ হাজার ৭৫১, ২১তম অবস্থানে থাকা নেদারল্যান্ডে ২০৯, ২২তম অবস্থানে থাকা ইকুয়েডরে ৫৯৯ ও ২৩তম অবস্থানে থাকা বেলারুশে ৯৪৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। অথচ এদিন বাংলাদেশে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৯৭৫ জন। একই দিন (২৫ মে) বিশ্ব করোনার তালিকার সবার শীর্ষে নাম থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ হাজার ৭৯০ জন নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলে ১৩ হাজার ৫১ জন, তৃতীয় অবস্থানে থাকা রাশিয়ায় ৮ হাজার ৯৪৫, ১০ম অবস্থানে থাকা ভারতে ৬ হাজার ৪১৪ জন, ১১তম অবস্থানে থাকা ইরানে ২ হাজার ২৩ জন, ১২তম অবস্থানে থাকা পেরুতে ৪ হাজার ২০ জন, ১৫তম অবস্থানে থাকা সৌদি আরবে ২ হাজার ২৩৫ জন, ১৬তম অবস্থানে থাকা চিলিতে ৪ হাজার ৮৯৫ জন, ১৭তম অবস্থানে থাকা মেক্সিকোতে ২ হাজার ৭৬৪ জন নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এ হিসাবে নতুন আক্রান্ত রোগীর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো শীর্ষ দশে। করোনায় আক্রান্ত বাকি ১৯১টি দেশের মধ্যে ৩১তম অবস্থানে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকায় ২৫ মে নতুন আক্রান্তের ১ হাজারের উপরে থাকলে বাকি ১৯০টি দেশে এ সংখ্যা ছিলো হাজারের কোটার নিচে। এর পরের দিন অর্থাৎ ২৬ মে বিশ্বের সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ হাজার ৪৯, ব্রাজিলে ১৫ হাজার ৬৯১, রাশিয়ায় ৮ হাজার ৯১৫, যুক্তরাজ্যে ২ হাজার ৪, ভারতে ৫ হাজার ৮৪৩, ইরানে ২ হাজার ৭৮৭, পেরুতে ৫ হাজার ৭৭২, চিলিতে ৩ হাজার ৯৬৪, সৌদি আরবে ১ হাজার ৯৩১, মেক্সিকোতে ২ হাজার ৪৮৫, পাকিস্তানে ১ হাজার ৩৫৬ ও কাতারে ১ হাজার ৭৪২ জন করোনায় আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশে নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যা ১ হাজার ১৬৬ জন। এ হিসাবে করোনায় নতুন করে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বিচারে বিশ্ব তালিকায় এদিন বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো আপাতদৃষ্টিতে ১৩তম স্থানে। তবে ঈদের ছুটি, কিট ও জনবল সংকট এবং কারিগরি সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে এদিন বাংলাদেশে ১১টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। এদিন মাত্র ৫ হাজার ৪০৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ গত কয়েক সপ্তাহের মতো এদিনও ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজারের বেশি হতো। মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে উপরে থাকা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ২৬ মে স্পেনে ৮৫৯ জন, ইতালিতে ৩৯৭ জন, জার্মানিতে ৪৯৯ জন, কানাডায় ৯৩৬ জন, চীনে ৭ জন, বেলজিয়ামে ১১৩ জন, নেদারল্যান্ডে ১৩৩ জন, বেলারুশে ৯১৫ জন নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এদিন বিশ্বের ৩৩তম স্থানে অবস্থানে থাকা কলম্বিয়া ছাড়া বাকি ১৯০টি দেশে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক হাজারের অনেক নিচে। ২৭ মে যে কয়টি দেশে সর্বাধিক নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫ হাজার ৪৭৪, ব্রাজিলে ২ হাজার ১৪৭, রাশিয়ায় ৮ হাজার ৩৩৮, যুক্তরাজ্যে ২ হাজার ১৩, ভারত ৪ হাজার ২৭, ইরান ২ হাজার ৮০, সৌদি আরব ১ হাজার ৮১৫, চিলি ৪ হাজার ৩২৮, মেক্সিকো ৩ হাজার ৪৫৫ জন করোনায় আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশে নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে ১ হাজার ৫৪১ জন। অর্থাৎ নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যার দিক থেকে এদিনও বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১০ নম্বরে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান তথ্য অনুযায়ী শুধু এ তিন দিনই নয়, বেশ কয়েকদিন ধরেই নতুন সংক্রমিত রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। যদিও নানাবিধ সংকটের কারণে এর মাঝে দুই দিন দেশে যথাযথভাবে নমুনা পরীক্ষা না হওয়ায় এ তালিকায় কিছুটা হেরফের ঘটেছে। করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য রেড জোন পেরিয়ে গত কয়েক সপ্তাহে করোনা যেভাবে বিভিন্ন জেলায় ভয়াবহ আকারে ছড়িয়েছে, তাতে খুব স্বল্প সময়েই এ অবস্থান আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে। এছাড়া সারা দেশে চলমান অঘোষিত লকডাউন সহসাই তুলে নিয়ে শিল্পকারখানা, অফিস-আদালত ও সব ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড সচল করার প্রস্তুতি এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রবণতা এ ঊর্ধ্বগতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা। স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, দেশে করোনায় নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন যে হারে বাড়ছে, তাতে এই বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসাসেবা দেয়া ডাক্তার-নার্সদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া স্বাভাবিক নিয়মে সংক্রমিত সবার নমুনা পরীক্ষা করাও দুষ্কর হবে। এ অবস্থায় এ মরণব্যাধির প্রকোপ ভয়াবহ রূপ নেয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সামাজিক দূরত্ব না মেনে এবং স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে ঈদের আগে ও পরে যেভাবে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে শহর ও গ্রামে আসা-যাওয়া করেছে তাতে নতুন করে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে। এছাড়া করোনার রেড জোনের বিপুল সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে গিয়ে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করায় এবং ঈদের পর কর্মস্থলে ফিরে আসায় দুই জায়গাতেই নতুন করে সংক্রমণ দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ওপর গত ২১ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পান বয়ে যাওয়ার সময় দেশের উপকূল অঞ্চলের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ বিভিন্ন সাইক্লোন সেন্টারে গাদাগাদি করে আশ্রয় নেয়ায় তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষ করে এসব দুর্গত এলাকায় সহজে করোনার নমুনা পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় সেখানে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আগের মতো ১০ হাজার কিংবা তারও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হলে প্রতিদিন নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যা আড়াই হাজার কিংবা তারও বেশি হবে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা। এদিকে দেশে করোনার ভয়াবহ বিস্তারের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জনগণের অসচেতনতা, চিকিৎসা ব্যবস্থার নাজুক দশা, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা চালু এবং ঈদকে সামনে রেখে মার্কেটসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিষয়গুলোকে দায়ী করলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে এ সংক্রামক ব্যাধি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ ছুটি দিয়ে সারা দেশে অঘোষিত লকডাউন ঘোষণা এবং সীমান্ত বন্ধসহ অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ এরপরও এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে দেশে করোনার প্রকোপ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের ঘর থেকে বের না হয়ে কোনো উপায়ই নেই। অন্তত কাজের জন্য, খাবার সংগ্রহের জন্য কিংবা ত্রাণ যোগাড়ের জন্য তাদের প্রতিদিনই কমবেশি বাসা থেকে বের হতে হয়। আর বেশিরভাগ মানুষ যখন ঘরে থাকছে না তখন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সংকটে পড়া মানুষের জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তা সংগ্রহ করতেও মানুষকে নির্ধারিত স্থানে জড়ো হতে হচ্ছে। গাদাগাদি ও হুড়োহুড়ি করে ত্রাণ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে একটি বড় জনগোষ্ঠী এখনো এমনভাবে বসবাস করে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বাস্তবে অসম্ভব। অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, দেশের ৪০ শতাংশ বাড়িতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ থাকে, যেখানে একটি কক্ষে ৫ কিংবা তার চেয়েও বেশি জন ঘুমায়। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তাদের পক্ষে কঠিন। এছাড়া আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে দেশের মানুষের অনিয়ন্ত্রিত আচরণও করোনার প্রকোপ বিস্তারের জন্য দায়ী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।