ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল্লাপুরের জাহাঙ্গীর মল্লিককে পিটিয়ে হত্যা
চুয়াডাঙ্গার ছয়ঘরিয়া কেরুজ বাণিজ্যিক খামার এলাকার বালুর খোলায় নৃসংসতা : স্থানীয় যুবলীগকে দোষারোপ
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধের জের ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর মল্লিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে সদর উপজেলার ছয়ঘরিয়া কেরুজ বাণিজ্যিক খামার এলাকায় তাকে পিটিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। তাকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসার এক পর্যায়ে বিকেল ৪টার দিতে মারা যান জাহাঙ্গীর মল্লিক।
নিহত জাহাঙ্গীর মল্লিক (৩৫) সদর উপজেলার নুরুল্লাপুর গ্রামের বিলপাড়ার রনজিত মল্লিকের ছেলে। তিনি তিতুদহ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। স্থানীয় যুবলীগের কয়েকজন তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন বলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শুকুর আলী অভিযোগ করেছেন। তবে যুবলীগ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ ঘটনায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে নিহত জাহাঙ্গীরের পিতা রনজিত মল্লিক চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, তিতুদহ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা শুকুর আলী ছয়ঘরিয়া গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বালু তুলে ব্যবসা করেন। অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রির আধিপত্য নিয়ে স্থানীয় দু’পক্ষের বিরোধ দানা বাধে। নিহত জাহাঙ্গীর মল্লিক ম্যানেজার হিসেবে শুকুর আলীর ওই বালুর ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। শুকুর আলীর অভিযোগ ছয়ঘরিয়া গ্রামের যুবলীগ নেতা আবদুল মোমিন, জিসান, লিমনসহ কয়েকজন আমার কাছে চাঁদাদাবি করে আসছিলো। চাঁদা না দেয়ায় ক্ষুব্ধ হন তারা। গতকাল বুধবার বেলা ২টার দিকে জাহাঙ্গীর মল্লিক ছয়ঘরিয়া কেরুজ মাঠ এলাকার বালু উত্তোলনস্থলে গেলে তাকে বেদম পিটিয়ে জখম করে তারা। স্থানীয়রা জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয়। নিহত জাহাঙ্গীরের ভাই ইকবাল হোসেন জানান, ‘বালু উত্তোলন ও চাঁদাদাবি নিয়ে প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপের সঙ্গে জাহাঙ্গীরদের বিরোধ চলে আসছিলো। সেই বিরোধের জের ধরেই বুধবার দুপুরে জাহাঙ্গীরকে কোদাল, ব্যালচা ও লাঠিসোঁঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।’ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, ‘জাহাঙ্গীর মল্লিকের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার একটি হাতও ভেঙে দেয়া হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।’
দর্শনা থানাধীন তিতুদহ ইউনিয়নের নুরুল্লাপুর গ্রামের অনেকেই জানান, জাহাঙ্গীর মল্লিক দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। তিনি কাতারের একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন। বিদেশ থাকাকালীন তার বউ তাকে তালাক দিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলে যান। বছর দুয়েক আগে বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরে জাহাঙ্গীর ছোটখাটো বালুর ব্যবসা করতেন। ঘটনার দিন গতকাল বুধবার সকালে ছয়ঘরিয়া গ্রামের জাহিদুল ইসলাম নামের একজন বালুব্যবসায়ী তাকে ডেকে নিয়ে যান। দুপুরের দিকে দুর্বৃত্তরা তাকে ছয়ঘরিয়া কেরুজ বাণিজ্যিক খামারের সামনে বালু গাদার কাছে নির্মমভাবে মারধর করে। মারধরের পর নির্জন মাঠে আহত জাহাঙ্গীরকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায় তারা। পরে কেউ একজন লোকজন ডেকে তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। বিকেলের দিকে জাহাঙ্গীর মল্লিক মারা যান। পরে পরিবারের লোকজন খবর পেয়ে হাসপাতাল যান। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন জাহাঙ্গীর। তার অন্য দুই ভাই ইদবার মল্লিক ও ইব্রাহিম মল্লিক। একমাত্র বোন রানু।
কেউ কেউ জানান, ঘটনার দিন বুধবার সকাল ৮টার দিকে ছয়ঘরিয়া গ্রামের জাহিদুল ও তিতুদহ ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি শুকুর আলী মোবাইলফোনে জাহাঙ্গীর মল্লিককে বালুর খোলায় পাঠান। পাওয়ারটিলারে করে বালু বিক্রি করতে গেলে প্রতিপক্ষের সাথে বাগবিত-া হয় জাহাঙ্গীরের। এক পর্যায় তাকে বেধড়ক মারপিট করে ঘটনাস্থলে ফেলে চলে যায় হামলাকারীরা।
তিতুদহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শুকুর আলী জানান, ‘জাহাঙ্গীর আমার বালুর ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। দুপুরে তিনি বালু উত্তোলনস্থলে গেলে তার ওপর হামলা চালানো হয়। হামলায় অংশ নেয় ছয়ঘরিয়া গ্রামের যুবলীগ নেতা আবদুল মোমিন, জিসান, লিমনসহ কয়েকজন।’ নিহত জাহাঙ্গীর মল্লিক তিতুদহ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন বলেও জানান তিনি। চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে যুবলীগের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। যুবলীগ হত্যার রাজনীতি করে না। তাদের বালু ব্যবসার অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তাছাড়া শুকুর আলী যাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ করছে তাদের বিরুদ্ধে শুকুর আলী আগেই মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা করে রেখেছেন। এ কারণে তারা এলাকায় থাকেন না। অথচ তাদের নামেই হত্যার অভিযোগ করা হচ্ছে। শুকুর আলীর লোকজনই পরিকল্পিতভাবে জাহাঙ্গীরকে হত্যা করে যুবলীগের লোকজনের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছেন।’
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি আবু জিহাদ খান জানান, ‘বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধের জেরে জাহাঙ্গীরকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ঘটনায় নিহত জাহাঙ্গীরের পিতা রনজিত মল্লিক বাদী হয়ে বুধবার রাতে ১১ জনের নাম উল্লেখপূর্বক একটি এজাহার দাখিল করেছেন।
এ খবর লেখা পর্যন্ত জাহাঙ্গীর মল্লিকের লাশ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে রাখা আছে। আজ বৃহস্পতিবার ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ পরিবারের নিকট হস্থান্তর করা হবে বলে হাসপাতালে থাকা জাহাঙ্গীরের পিতা রনজিত মল্লিক ও মা সূর্যবানু জানান।