গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুরের গাংনীর ইবি ছাত্রী নিশাত তাসনিম উর্মি হত্যাকা-ের মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন বিজ্ঞ আদালত। গাংনী থানা পুলিশের দেয়া চার্জশিটে আসামিদের রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী গোলাম কিবরিয়া। অজ্ঞাত কারণে ময়নাতদন্তকারী টিম এবং মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা জোগসাজসে চার্জশিট তৈরী করা হয়েছে মর্মে অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তার চার্জশিট গ্রহণ করেননি।
জানা গেছে, মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদনে উর্মিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করেছেন মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া। মূলত পুলিশের গোপন তদন্ত কিংবা স্বাক্ষীদের কোনো বয়ানের গুরুত্ব নেই এই প্রতিবেদনে। উর্মি হত্যা মামলার প্রধান আসামি তার স্বামী প্রিন্স ও তার পিতা কাছ থেকে পাওয়া তথ্য দিয়েই তিনি প্রতিবেদন সাজিয়েছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে আমামিদের বাঁচানোর জন্য আসল ঘটনা আড়াল করেছেন বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
অভিযোগ রয়েছে, নিহত উর্মির গলা টিপে হত্যা করার মত আঙুলের দাগ বিদ্যামান ছিলো। এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ডিএনএ টেস্ট করার বিষয়টি এগিড়ে গেছেন চিকিৎসক মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে হত্যার সময় নির্দিষ্ট করে লেখার বিধান থাকলেও তা উপেক্ষিত।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাতে উর্মী গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে মর্মে সংবাদ দেয় তার উর্মীর পরিবারকে এবং উর্মীর মরদেহ গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন উর্মীর শ্বশুর ও পরিবারের লোকজন। এ ব্যাপারে গাংনী থানায় একটি মামলা হয় যার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন গাংনী থানার সাব ইন্সেপেক্টর (এসআই) শাহীন মিয়া। তিনি সম্প্রতি মেহেরপুর আদালতে মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। যার শুনানিতে মামলার বাদি নিহত উর্মির পিতা গোলাম কিবরিয়া অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এসআই শাহীন মিয়া তদন্ত প্রতিবেদনে উর্মি হত্যাকা- নয়; আত্মহত্যা করেছেন মর্মে উল্লেখ করেন। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে উর্মির স্বামী আশফাকুজ্জামান প্রিন্সকে দায়ী করে তার বাবা মাকে মামলা থেকে অব্যহতি দিয়ে আবেদন করেন তিনি। যা একটি হত্যাকা-ের ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে আসামিদের রক্ষার চেষ্টা বলে আখ্যায়িত করেছেন মামলার বাদি।
এদিকে নিহত উর্মির সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত নিয়ে আবারও অভিযোগে করেছেন তার পিতা গোলাম কিবরিয়া। অভিযোগে তিনি জানান, সুরতহাল প্রতিবেদনের সাথে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের কোনো মিল নেই। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা পরিকল্পিতভাবে একটি হত্যাকা-কে ধামাচাপা দিয়েছেন। যার সূত্র ধরে এসআই শাহীন মিয়া চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মামলার এজাহার, সুরতহাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও চুড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে নানা গড়মিল লক্ষ্যণীয়। এজাহারে উল্লেখিত স্বাক্ষীদের কোনোপ্রকার স্বাক্ষ্য নেয়া হয়নি। একটি সাদা কাগজে দুজন স্বাক্ষীর স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এসআই শাহীন মিয়া আসামিদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় বয়ান লিপিবদ্ধ করেছেন।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবি ছাত্রী উর্মিকে স্বামীর বাড়িতে শারীরিক নির্যাতন ও শ^াসরোধে হত্যা করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়। উর্মির স্বামীর বসতঘরের জানালার পর্দা টাঙানো হুকের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার করা হয়েছে বলে দাবী করেছে তার স্বামী পক্ষের লোকজন। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন মরদেহ উদ্ধারের পর সেই স্থানটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এমন একটি স্থানে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে কোনভাবেই আত্মহত্যা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন সকলেই। গাংনী থানায় মরদেহ নেয়া হলে হাজারো মানুষ নিহতের শরীরের নানা স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে হত্যা মামলা নেয় পুলিশ। কিন্তু মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার সময় আত্মহত্যার দাবিকৃত স্থানটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কারও মতামত নেননি মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা গাংনী থানার এসআই শাহীন মিয়া এবং নিহতের শরীরের আঘাতের চিহ্ন সম্পর্কেও আমলে নেননি তিনি।
এদিকে চুড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার সময় উর্মির স্বামী এবং উর্মি হত্যা মামলার প্রধান আসামি আশফাকুজ্জামান প্রিন্স নিজ ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলেন বলে দাবি করেছেন মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০ টার মধ্যে। এ সময়ে বাড়ির সব মানুষ ঘুমিয়ে থাকার বিষয়টিও সন্দেহজনক।
মরদেহ উদ্ধারের পর গাংনী থানার এসআই শাহীন মিয়া সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরী করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, উর্মির গলার ডান দিকে আঙুলের কালো দাগ রয়েছে। পিঠে ও কোমরে মারধর করা কালশিরা চিহ্ন বিদ্যমান এবং শরীরের কোথাও তরল পদার্থ নির্গত হবার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। হত্যাকা-ের সন্দেহের এই বিষয়গুলো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে অনুপস্থিত। ময়নাতদন্ত রির্পোটে সুরতহাল রির্পোটের কোন মিল নেই। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া চুড়ান্ত প্রতিবেদনে সুরতহাল রিপোর্টের গলার দাগের বিষয়টিও এড়িয়ে গেছেন।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সঠিক হয়নি মর্মে আগেই অভিযোগ করেছেন মামলার বাদি। ভিসেরা রিপোর্ট তৈরীর জন্য উর্মির শরীরের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ না করে শুধুমাত্র পাকস্থলিতে বিষক্রিয়া আছে কি না তার নমুনা সংগ্রহ করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড। আবার দীর্ঘ ২২ দিন সেই উপকরণ হাসপাতালে ফেলে রেখেছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ হলে টনক নড়ে মেডিকেল বোর্ডের। পরে মনগড়া একটি ময়নাতদন্ত করে আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন দেয় বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী গোলাম কিবরিয়া। একই সাথে ময়নাতদন্তের কোন প্রাথমিক প্রতিবেদন দেয়া হয়নি। প্রতিটি ময়নাতদন্তের বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন সঙ্গে সঙ্গে দেয়ার বিধান থাকলেও উর্মির বেলায় কেন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন মানুষের মাঝে।
স্থানীয়দের দাবি, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যেহেতু বিতর্কিত হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন দাঁড় করানো হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক টিম এবং মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তার জোগসাজসে একটি হত্যাকা-কে আড়াল করা হচ্ছে কি না তা পিবিআই সুষ্ঠুভাবে খতিয়ে দেখবে। এমনটি প্রত্যাশা গাংনীর সচেতন মহলের।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী একরামুল হক হীরা জানান, মামলার তদন্তে বেশ কয়েক জায়গায় গড়মিল রয়েছে। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এ তদন্তে হত্যা না আত্মহত্যা তা উঠে আসবে এবং ভুক্তভোগী ন্যায় বিচার পাবেন বলেও তিনি আশাবাদী।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (পিবিআই) গোকুল চন্দ্র অধিকারী জানান, আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্তের কাজ এগিয়ে চলেছে। মামলার তদন্ত শেষ হবার আগে কিছুই বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত হবে বলেও তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন।
প্রসঙ্গত, নিহত উর্মির পিতা গোলাম কিবরিয়া যৌতুকের নগদ টাকা দিতে না পেরে উর্মির নামে এক বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দেন ২০১৯ সালে। যার দলিল প্রিন্সের কাছেই ছিলো। এই জমি বিক্রি করে স্বামী প্রিন্স প্রাইভেটকার কেনার জন্য স্ত্রী উর্মির ওপর নির্যাতন করে আসছিলেন। পরে প্রিন্সের পিতা তাকে প্রাইভেট কার কিনে দেয়। এ নিয়ে প্রিন্স ও তার বাবা মায়ের রোষানলে পড়েন উর্মি। এর সূত্র ধরেই মূলত প্রায় প্রতিদিনই নির্যাতন সইতে হতো উর্মিকে। মামলার এজাহারে বাদি গোলাম কিবরিয়া দলিলটি প্রিন্সের বাড়িতে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া দলিলের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন তদন্ত প্রতিবেদনে।