আলমডাঙ্গার মধুপুরের পল্লি প্রাণি চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অপচিকিৎসার অভিযোগ

খামারি লিটনের মারা গেছে দুটি গরু ॥ খামারে ১৪টি গুরুতর অসুস্থ

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: গরু খামারি লিটন জোয়ার্দ্দার। তিনি আলমডাঙ্গা উপজেলার মধুপুর গ্রামের আমির আলী জোয়ার্দ্দারের ছেলে। লিটন দীর্ঘ ১৭ বছর দুবাই ছিলেন। বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বেশ কয়েক লাখ টাকা জমিয়েছিলেন। দেশে ফিরে জমানো টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। ৭ মাস পূর্বে তিনি জমানো ২২ লাখ টাকা দিয়ে ২১টি গরু কেনেন মোটাতাজা করে বিক্রির জন্য। রাত-দিন গরুগুলো খাওয়ানো ও যতœ-আত্তি করেন। চার মাসে প্রায় ৮ লাখ টাকা গরুগুলোর পেছনে খরচ করেছেন। বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে গুরুগুলো। খামারি লিটন জোয়ার্দ্দার স্বপ্ন দেখেন আগামী ঈদকে সামনে রেখে সেগুলো বিক্রি করবেন। কম করে হলেও ৫০ লাখে বিক্রি হবে তার গরুগুলো। তাতে ১২ থেকে ১৫ লাখ লাভ হবে তার। গ্রামের অভিজ্ঞ অনেক খামারি তাকে এমন লাভ হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন।
মধুপুরের পাশের গ্রাম ঘোষবিলা। ওই গ্রামের নজরুল ইসলাম পল্লি প্রাণি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন গ্রামে গ্রামে। তিনি লিটন জোয়ার্দ্দারের খামারে আসেন মাঝে মধ্যে। তিনি গরুগুলি দেখে পরামর্শ দেন কলিজায় ইঞ্জেকশন দেয়ার। তা না হলে আর দ্রুত মোটাতাজা হবে না। লাভ বেশি হবে না বলে সাবধান করে যান। নজরুল ইসলামের পীড়াপীড়িতে লিটন জোয়ার্দ্দার গরুগুলোর চিকিৎসা করাতে রাজি হন। গত বছরের ৩ নভেম্বর তিনি ২১টি গরুর কলিজায় ইঞ্জেকশন দেন। ইঞ্জেকশন দেয়ার পরপরই গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিষয়টি নজরুল ইসলামকে জানালে তিনি মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট ও পাউডার ওষুধ দেন। এতে পাতলা পায়খানা শুরু হয়। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হলে চিন্তায় পড়ে যান খামারি লিটন। তিনি নজরুল ইসলামকে বার বার ডাকলেও তাতে তিনি সাড়া দেননি। বাধ্য হয়ে খামারি লিটন উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে অভিযোগ দেন।
উপজেলা প্রাণি সম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ডা. এ এন এম মোস্তাকিম মুকুট চিকিৎসক পাঠিয়ে চিকিৎসা করেন। তবুও অবস্থার উন্নতি হয়নি। গরুগুলো খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিটা গরু এখন হাড্ডিসার অবস্থা। একবার শুয়ে পড়লে আর উঠতে পারছে না। এরই মাঝে দুটি গরু মারা গেছে। অপেক্ষাকৃত বেশি অসুস্থ ৫টি গরু বিক্রি করতে বালিয়াপাড়া হাটে নিয়ে যান। বেশি অসুস্থ হওয়ায় দুটি গরু বিক্রি হয়েছে। সেখানে অবিক্রিত ৩টি গরু এতটাই অসুস্থ ছিল যে আর বাড়িতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। দোবিলা নামক গ্রামে ফেলে রেখে চলে এসেছেন খামারি মালিক লিটন। চোখের সামনে বাকী ১৪টি গরু মরতে চলেছে। এতে ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হবে বলে খামারি দাবি করেছেন। অনেক প্রত্যাশায় গড়ে তোলা খামারের স্বপ্ন, তার আর্থিক স্বাচ্ছন্দময় ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্নসাধ সব ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। একেবারে পথে বসেছেন তিনি।
খামারি লিটন জোয়ার্দ্দারের পরিবার এখন শোকবিহ্বল। জমানো সমস্ত অর্থ হারানোর বেদনায় মলিন হয়ে পড়েছে বাড়ির সকলের মুখ। ভেঙে গেছে তার স্বপ্ন। বোবা কান্নায় গুমরিয়ে গুমরিয়ে উঠছে তার বুক।
খামারি লিটন আলী বলেন, গরু কেনার পর সেগুলো সুস্থ ছিল। এ সময় নজরুল ডাক্তার এসে গরুর কলিজায় ইনজেকশন দেয়ার কথা বলে এবং তিনি নিজে ওষুধ কিনে নিয়ে আসে। ইনজেকশন দেয়ার পর ওষুধের প্যাকেটগুলো নিয়ে যান নজরুল এবং একটি পাউডারের নাম কাগজে লিখে যান। পাউডারটি খাওয়ানোর পরেই গরুর পাতলা পায়খানা ও ত্রুটি ফোলা শুরু হয়। আমি ১৭ বছর বিদেশ ছিলাম। আমার সমস্ত ইনকাম এই খামারের লাগিয়েছিলাম। ব্যাংকে আমার ঋণ আছে। বর্তমানে আমি নিঃস্ব। এই গরুগুলো যদি আমি ভালোভাবে বিক্রি করতে পারতাম তাহলে ৫০ লাখ টাকার ওপরে বিক্রি হতো। আমি এর বিচার চাই। এ বিষয়ে আমি প্রাণিসম্পদ অফিসার মুকুট স্যারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি।
প্রতিবেশী শামীম রেজা বলেন, গরুগুলো কেনার সময় সবই সুস্থ ছিলো। নজরুল ডাক্তার ক্রিমি ও কলিজার ইনজেকশন করে। সেখান থেকেই গরুর এই অবস্থা। আলমডাঙ্গা থেকে ডাক্তার এনে দেখানো হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, নজরুল ডাক্তারকে ডাকতে। ডাকলেও তিনি আর আসছেন না।
আরেক প্রতিবেশী ইসমাইল হোসেন বলেন, গরুগুলো সুস্থই ছিল। নজরুল ডাক্তার কি এক কলিজার ইনজেকশন দেয়ার পরে গরুর এই অবস্থা। লাখ টাকা দামে কেনা গরু এখন ২০ হাজার টাকায়ও কেউ নেবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘোষবিলা গ্রামের পল্লি প্রাণিসম্পদ চিকিৎসক নজরুল ইসলাম আলমডাঙ্গা প্রাণিসম্পদ অফিসে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ভেটেরিনারী পাবলিক হেলথ সার্ভিস জোরদার প্রকল্পে ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে ৪ বছর চাকরী করেছেন। তিনি ঝিনাইদহ যুব উন্নয়ন থেকে ৬ মাসের প্রাণিসম্পদ চিকিৎসার ওপর কোর্স করেছেন। এলাকায় তিনি প্রাণি চিকিৎসা করেন।
অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম বলেন, শীতে মানুষের মত গরুরও ঠান্ডা লাগে, টনসিলে সমস্যা হয়। সেজন্য গত বছরের ৩ নভেম্বর আমি গরুগুলোর ভিপ্লেক্স ও রেনাসিন ইঞ্জেকশন করেছিলাম। এতে গরুর পাতলা পায়খানা হওয়া কিংবা অসুস্থ হওয়ার কথা না। পরে তারা কি ওষুধ খাইয়েছে তা জানি না। আমাকে আর বলেনি। তারা আলমডাঙ্গা থেকে ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাচ্ছে। আর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে।
উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এস এম মাহমুদুল হক জানান, তিনি ঘটনাস্থলে চিকিৎসক দল পাঠিয়েছিলেন। চিকিৎসা দেয়ার পর এখন কিছুটা সুস্থ। ধারণা করা হচ্ছে এটা গরুর ‘বোটল জ্ব’ রোগ। নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ খামারি করছেন, নজরুল ইসলাম তা স্বীকার করছেন না।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More