বাগদিদের খোঁজ রাখে না কেউ : লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সামান্য রোজগারে সংসারে চালাতে দিশেহারা তারা
হরিণাকুণ্ডু প্রতিনিধি: কাকডাকা ভোরে দল বেঁধে ছুটছেন কয়েক নারী। তাঁদের সঙ্গে আছে হাঁড়ি-পাতিল, ঝুড়ি, দা-কোদাল, ছিপ-বড়শি। দিনভর চষে বেড়াবেন গাঁওগেরামের খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, নদী-নালা। সেখান থেকে তারা ধরবেন মাছ, কাঁকড়া-কুঁচিয়া ও কচ্ছপ। ভাগ্য সহায় হলে শিকার করবেন খরগোশও। বিকেল গড়িয়ে ঘোর সন্ধ্যায় তারা ফিরবেন চিথলিয়াপাড়ার বাড়িতে। এর পর শুরু আরেক পর্ব। ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু পৌর শহরের ব্যস্ত মোড়ে মোড়ে জটলা করে বসবেন নারীরা। ডালায় সাজানো হবে মাছ। ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষি। দিন শেষে কারও আয় হবে ২০০ টাকা। কেউ আবার ২৫০ টাকা নিয়ে ফিরবেন ঘরে। এ দিয়েই মেটাতে হবে সংসার খরচ। নিত্যদিন এমন করেই কাটিয়ে যাচ্ছেন বাগদি জাতিগোষ্ঠীর নারীরা। হরিণাকু-ু শহরের প্রাণকেন্দ্র চিথলিয়াপাড়ায় পৌরসভা সড়কের গা গেঁষে তাদের পল্লি। সব মিলিয়ে কয়েকশ মানুষের বাস এখানে। সবাই বাগদি। সেই বাগদি জাতির মানুষ তারা, যাদের উদ্দেশে প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ হেনরি লুইস মর্গান বলেছিলেন, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী।’ যুগের পর যুগ চলে যায়, তাদের জীবনধারায় যেন এসবের ছোঁয়া লাগে না তেমন একটা। আদিবাসী এ সম্প্রদায়ের নারীরাই নানা উপায়ে উপার্জনের জন্য শ্রম দেন। সাংসারিক কাজ আর পরিবারের অন্য সদস্যদের দেখভালো করেন পুরুষ সদস্যরা। সময়ে সময়ে অবশ্য তারাও হাল ধরেন। তাদের কেউবা সেলুন ও হোটেলে কাজ করেন। অনেকে মাছ ধরেন। এ সময়ে এসে রিকশা-ভ্যান চালকের পেশাও নিয়েছেন কেউ। ৯ সদস্যের পরিবারের খাবার জোটাতে প্রতিদিন সকালে বের হতে হয় নিমবালাকে। গ্রামে মাছ ধরে অন্য নারীদের মতো সন্ধ্যায় ফেরেন বাড়ি। রাতে শহরে মাছ বিক্রি করে ২০০-২৫০ টাকা আয় হয় তার। প্রতিদিন তার পরিবারে চালই লাগে পাঁচ কেজির মতো। বাজারে বর্তমানে ৫০ টাকার নিচে এক কেজি মোটা চালও মেলে না। ফলে আয়ের পুরোটাই চলে যায় চাল কিনতেই। ডাল-তেল আর তরিতরকারির বাজারও চড়া। তাই একটা কিনলে অন্যটা কেনার টাকা থাকে না নিমবালার গাঁটে। তাই কোনো বেলায় চিড়া-মুড়ি, কখনও শুধু ডাল-ভাত জোটে। পল্লির অন্যতম প্রবীণ বাসিন্দা বাসুদেব বিশ্বাসের (৭০) আক্ষেপ, বংশপরম্পরায় এ এলাকায় বসবাস করলেও তাদের জন্য কেউ ভাবে না। কেউ খোঁজ নিতেও আসে না। বাসুদেব বলেন, তার সম্প্রদায়ের অল্প ক’জন বয়স্ক ভাতাসহ নানা সহায়তা পেলেও তিনি কিছুই পাননি। বছরে একবার ঈদের সময় পৌরসভা থেকে সামান্য চাল পান। শীতে মেলে একটি কম্বল। আর কেউ খোঁজ নেয় না। বাগদি নারীদের অনেকে আবার ধানের মরসুম শেষ হলে ইঁদুরের গর্ত খোঁড়েন। সেখান থেকে কুড়িয়ে পান কিছু ধান। কখনও কাঠ কেটে ও খড়ি কুড়িয়ে বিক্রি করেন। সামান্য আয়ে ডাল-ভাত খেয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন সংসার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সামান্য এ রোজগারে সংসারে চালাতে দিশেহারা তারা। মাছ-মাংস বা ভালো খাবার কালেভাদ্রেও জোটে না। বেশ কয়েক বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন যমুনা রানী। বিধবা ভাতা হিসেবে যে ক’টি টাকা পান, তা দিয়ে সারা মাসের ওষুধের খরচও হয় না। তাই পাড়ার অন্যদের সঙ্গে মাছ ধরতে যান। যমুনার ভাষ্য, আগের আটার দাম কম ছিলো। ফলে মাসের অর্ধেক সময় রুটি খেয়ে পার করতেন। এখন প্রতি কেজি আটার দামই ৬৫-৭০ টাকা। ফলে বাধ্য হয়ে দু’বেলা ডাল-ভাত খেয়েই পার করেন পরিবারের সদস্যরা। মাছ ধরার সামান্য আয়ে সংসার চলে না। ঝিনাইদহ পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় আদিবাসী পরিবার আছে ৭০৪টি। সব মিলিয়ে মোট ৩ হাজার ১০৮ জনের বাস এ জেলায়। তাদের মধ্যে অন্যতম বাগদি, কোল, পাহাড়ি, বর্মণ ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর সদস্যই বেশি। হরিণাকু-ু উপজেলায় যে ৮৭টি পরিবার আছে, তদের বেশিরভাগই বাগদি। তাদের মোট সংখ্যা ৪১০। এ জাতির সদস্যরা সরকারিভাবে ‘হিন্দু তপশিলি জাতিবিশেষ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। সারাদেশে তাদের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর এবং উত্তর-মধ্যাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরেই তাদের বসবাস। দেশের মূল জনস্রোত থেকে এখনও একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন বাগদিরা। যে কারণে শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসাসহ মৌলিক নানা অধিকার পৌঁছায়নি তাদের কাছে। প্রতিনিয়ত বাল্যবিয়ের শিকারও হচ্ছেন মেয়েরা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এরিয়া ম্যানেজার আসাদুজ্জামান বলেন, আগে বাগদিদের জন্য তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ কিছু বিষয়ে প্রকল্প ছিলো। এখন নেই। ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বাগদিদের নেতা সমির বিশ্বাস বলেন, প্রতি বছর সরকার থেকে তাঁদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি, উপকরণসহ কিছু সুযোগ-সুবিধা মেলে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। সমাজসেবা কর্মকর্তা শিউলী রানী বলেন, উপজেলার আদিবাসী পরিবারের ৩৭ জন প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে বিশেষ ভাতা পান। এ ছাড়া ৭৫০ টাকা করে ৪৮ জনকে দেওয়া হয় অনগ্রসর শিক্ষা উপবৃত্তি। তবে এটি শুধু বাগদিদের জন্য নয়, উপজেলার সব আদিবাসীর জন্য। হরিণাকু-ু পৌর মেয়র ফারুক হোসেন বলেন, বাগদিদের অনেকে সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনেকেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। যারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি, তাদের দ্রুত এসব কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। ইউএনও সুস্মিতা সাহা বলেন, তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নেও ইতোমধ্যে উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন উপকরণ দেয়া হচ্ছে। অনেককে ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে। আরও ঘর দেয়া হবে।