মাজেদুল হক মানিক: রাজা ও জমিদারকে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী ছিলো। নিরাপত্তা ও প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা হতো। বাছাই করে লাঠিয়াল জওয়ান নিয়োগ দিতেন রাজা-বাদশরা। সময়ের পরিক্রমায় লাঠিখেলা গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আর এ লাঠিখেলায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে নারীদের অংশগ্রহণ। দর্শকদের মন জয় করছেন এসব নারী লাঠিয়ালরা।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে গ্রামীণ খেলাধুলার অন্যতম একটি অংশ লাঠিখেলা। সুদীর্ঘকাল থেকে এ খেলার সাথে গ্রামের মানুষের পরিচিতি রয়েছে। গ্রামীণ মেলার একটি বড় অংশ জুড়েই ছিলো লাঠিখেলার প্রাধান্য। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে লাঠির মারপ্যাচ আর আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করাই ছিলো লাঠিয়ালদের মূল উদ্দেশ্য। প্রতিযোগিতাপূর্ণ খেলায় সেই দৃশ্যই তুলে ধরেন লাঠিয়ালরা। এবার সেই লাঠিখেলায় নতুন মাত্রা যুক্ত করছেন নারী লাঠিয়াল দলের সদস্যরা। গাংনী উপজেলার চরগোয়াল গ্রামে শনিবার দিনব্যাপী লাঠিখেলায় উপস্থিত ছিলেন কুষ্টিয়া লাঠিয়াল বাহিনীর কয়েকজন সদস্য। যাদের লাঠির কৌশল বীরত্বপূর্ণ বলে আখ্যা দেন উপস্থিত দর্শকরা। আত্মরক্ষা করে প্রতিপক্ষের ওপর লাঠি ঘুরিয়ে পরাস্ত করার দৃশ্য উপভোগ করেন কয়েকজন হাজার দর্শক। পুরুষের চেয়ে শক্তিতে নারীরা যে পিছিয়ে নেই তা প্রমাণ করেন লাঠি চালানোর মনোমুগ্ধকর কলাকৌশলের মাধ্যমে। লাঠিখেলার মাধ্যমে নারী আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন নারী লাঠিয়ালরা। লাঠি খেলা অনুশীলনকারীকে লাঠিয়াল বলা হয়। এই খেলার জন্য লাঠি হয় সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা, তবে মসৃণ। প্রত্যেক খেলোয়ার তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করেন। লাঠির ঠক ঠক আওয়াজ আর ঢোলের শব্দের পাশাপাশি লাঠিয়ালদের হাকডাক ও দর্শকদের করতালি সৃষ্টি করে এক উৎসবমুখর পরিবেশ।
এ লাঠি খেলায় ১২টি দল অংশ নেয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে মাঠে নামেন লাঠিয়ালরা। তারা কখনও ঢোল আর কাঁসরের তালে তালে নেচে নেচে তাদের কসরত দেখান। আবার কখনও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চালান লাঠি ও সড়কি। প্রতিপক্ষ লাঠিয়াল সেই আঘাত ঠেকিয়ে প্রতিঘাত করতে সদা প্রস্তুত বেতের তৈরী ঢাল আর লাঠি নিয়ে। আবার কেউ কেউ লাঠি ঘুরিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করেন। নারী লাঠিয়ালরা তাদের রণকৌশল দিয়ে পুরুষ লাঠিয়ালদের কুপোকাত করেছেন। এতে দর্শকদের আনন্দে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা।
প্রবীণ লাঠিয়াল আব্দুর রশীদ জানান, আগে ছিলো জমিদারি প্রথা। সেকালে ছিলো না এত আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি। বিভিন্ন সময়ে জমিদারদের মধ্যে বিভিন্ন বিভেদ গায়ের জোরে মীমাংসা করা হতো। এক্ষেত্রে যার যত লাঠিয়াল ছিলো তার ততো বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। আগে জমিদার, জোতদাররা বংশপরম্পরায় লাঠিয়াল পুষতেন। লাঠি দিয়ে আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতেন লাঠিয়াল ওস্তাদেরা।
লাঠিয়াল সাকেম আলী জানান, এক সময় চোর ডাকাত আর প্রতিপক্ষের হামলা থেকে রক্ষা পেতে লাঠিখেলার কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া দর্শকদের আনন্দেরও খোরাক এ খেলার কলা কৌশল ও শারীরিক কসরত। তবে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ বেশ ইতিবাচক বলেও জানিয়েছেন তিনি।
নারী লাঠিয়াল রুপন্তি চৌধুরী জানান, বর্তমানে সকল ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনেক সময় নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হন। নারীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি ও আত্মরক্ষার জন্য লাঠিখেলা রপ্ত করা প্রয়োজন। জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী লাঠিয়ালদের নৈপুণ্য তুলে ধরতে চান তিনি।
মটমুড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সোহেল আহম্মেদ জানান, লাঠিখেলা শুধু আত্মরক্ষার কৌশলই নয়, এটি গ্রামীণ সাংস্কৃতির একটি অংশ। প্রতি বছরই এর আয়োজন করা হয়। পুরুষদের পাশাপাশি নারী লাঠিয়ালদের অংশগ্রহণ এ খেলাকে অনেক দূর এগিয়ে নিবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সেই সাথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ ধরনের আয়োজন অব্যহত রাখার প্রচেষ্টার কথা জানালেন এই চেয়ারম্যান।