জীবননগরে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বেশি দামে সার বিক্রি

কৃষি অফিসে অভিযোগ দিয়েও মিলছে না প্রতিকার : তদারকি না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকেরা

সালাউদ্দীন কাজল: চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে সার বিক্রেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। উপজেলার অধিকাংশ খুচরা সার ব্যবসায়ী, বিএডিসি এবং বিসিআইসি অনুমোদিত ২-৩ জন সার ডিলার সরকার নির্ধারিত দামের তোয়াক্কা না করে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। ন্যায্য মূল্যে সার না পেয়ে প্রতিনিয়ত বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। উপজেলা কৃষি অফিসে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার মিলছে না বলে দাবি কৃষকদের। তবে, উপজেলা কৃষি অফিসের দাবি সরকার নির্ধারিত মূল্যেই সার বিক্রি হচ্ছে।

রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৪টায় জীবননগর উপজেলার রায়পুর বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, খুচরা সার ব্যবসায়ী মো. আয়নাল হক ১১০০ টাকা মূল্যের প্রতিবস্তা ইউরিয়া ১২৫০ টাকা দরে এবং ৭৫০ টাকা মূল্যের প্রতিবস্তা পটাশ সার ১৫০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। এছাড়া একই বাজারের খুচরা সার ব্যবসায়ী কলম হোসেন, ফারুক হোসেন, ইমরান হোসেন এবং তালেব হোসেন ১১০০ টাকা মূল্যের প্রতিবস্তা ইউরিয়া ১৩৫০ টাকা এবং ৭৫০ টাকা মূল্যের প্রতিবস্তা পটাশ সার ১৫০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। পরে মিনাজপুর বাজার এবং বাড়ান্দি বাজার ঘুরে দেখা গেছে অধিকাংশ সার ব্যবসায়ী সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যে সার বিক্রি করছেন না। কোনো অপিরিচিত মানুষ সারের দোকানে ইউরিয়া এবং পটাশ সার কিনতে গেলে তাকে বলা হচ্ছে সার নেই। পরক্ষণেই পরিচিত কৃষক গেলে তাদের কাছে অধিক মূল্যে সার বিক্রি করা হচ্ছে।

এদিকে বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) অনুমোদিত জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়ীয়া ইউনিয়নের জন্য ট্যাগ করা হক ট্রেডার্সে বিকেল ৬টার সময় গিয়ে দোকান বন্ধ পাওয়া গেছে। ওই সময় সার কিনতে আসা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকরা জানান, অধিকাংশ সময় দোকান বন্ধ থাকে। কৃষকদের অভিযোগ হক ট্রেডার্সের বেশিরভাগ সার রাতের আধারে অধিক মূল্যে খুচরা দোকানদারদের কাছে বিক্রি করে দেন।

কৃষকরা যাতে সময়মতো জমিতে সার দিতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে সরকারের বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) সারাদেশের ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে সার বিপণনের কাজটি করে থাকেন। সরকারি নিয়ম মোতাবেক প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে ডিলার নিয়োগ দেয়া আছে। ওইসব ডিলারের স্ব স্ব ইউনিয়নেই ব্যবসা পরিচালনা করার শর্তে তাদের ডিলারশিপ দেয়া হয়েছে। অথচ পৌরসভার মধ্যেই অধিকাংশ সার ব্যবাসয়ীদের গোডাউন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জীবননগর উপজেলা শহরের দত্তনগর সড়কের দু’পাশে একাধিক ইউনিয়নের সারের ডিলার রয়েছে। অথচ ওই ডিলারদের ইউনিয়নে গোডাউন রেখে প্রান্তিক কৃষকদের কাছে সার বিক্রির কথা রয়েছে।

কৃষকদের দাবি, ডিলাররা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সারের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে কৃষকদের বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য করছে।

এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, জীবননগরে সার ব্যবসায় কৃষি বিভাগের বিন্দুমাত্র তদারকি নেই। আর তদারকি না থাকায় ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতোই চালাচ্ছেন নিজেদের ব্যবসা। সার ডিলারদের ক্যাশ মেমোর মাধ্যমে চাষিদের কাছে সার বিক্রির নিয়ম থাকলেও বেশি দামে বিক্রির কারণে তা করছেন না ডিলাররা।

এছাড়া খুচরা সার ব্যবসায়ীরা অধিক দামে সার বিক্রি করলেও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কাছে কৃষকদের পক্ষে কোনো অভিযোগ-অনুযোগ কিংবা পর্যাপ্ত প্রমাণাদি নেই। প্রমাণস্বরূপ তারা দোকানের বিক্রি রশিদ বা প্রমাণপত্র চান।

অভিযোগ রয়েছে, ক্রেতাদের কেউ রসিদ চাইলে তাদের সরকার নির্ধারিত দাম উল্লেখ করেই রশিদ দেয়া হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার কাছে সার বিক্রি করছেন না তারা। বলছেন, দোকানে সার নেই।  যা আছে বাইরে থেকে অতিরিক্ত দামে কেনা সার।

জীবননগর উপজেলার কৃষকরা তাদের জমিতে চলতি আমন মরসুমে ইউরিয়া ও পটাশ সার দিতে না পেরে কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে বলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

কৃষকদের অভিযোগ, সারের সঙ্কট দেখিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের। দোকানে সার কিনতে গেলে তাদের বলা হচ্ছে সার নেই। অনেক দোকানদার বলছেন, সার বেশি দামে কিনছি তাই বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে। কিন্তু নির্দিষ্ট দামে কৃষকরা সার কিনতে চাইলে বলা হচ্ছে সারের সঙ্কট রয়েছে।

কৃষকরা আরও অভিযোগ করেন, দোকানদারদের কাছে সরকারি দরে ক্যাশ মেমোসহ সার কিনতে গেলে পটাশ ও ইউরিয়া সার নেই বলে জানিয়ে দেন। আর বেশি দামে দিলেই পাওয়া যায় পর্যাপ্ত সার।

পশ্চিম বাড়ান্দি গ্রামের কৃষক সুফি আলম বলেন, আমাদের এলাকায় সারের  কোনো ডিলার আছে কি-না আমার জানা নেই। আমরা শহরের গোডাউন থেকে অধিক দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছি।

একই কথা জানালেন আন্দুলবাড়ীয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের কৃষক গোলাম রহমান। তিনি বলেন, আমরা প্রতি কেজি ইউরিয়া ২৭ টাকা এবং পটাশ ৩০ টাকা দরে কিনছি।

জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, বেশি দামে সার বিক্রি করার অভিযোগ পেলে ওই সার ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল করা হবে। ইতোমধ্যে সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যে সার বিক্রি করার জন্য উপজেলার বিসিআইসি ও বিএডিসি অনুমোদিত সার ডিলারসহ খুচরা সার বিক্রেতাদের সতর্ক করা হয়েছে।

জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, কৃষকরা হলো দেশের প্রাণ। সার ব্যবসায়ীরা যদি কৃষকদের জিম্মি করে বেশি দামে সার বিক্রি করে থাকে তাহলে ওই দোকানদারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন থেকে নিয়মিত সারের বাজার মনিটরিং করা হবে। অধিক মূল্যে সার বিক্রিকারীর বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল-জরিমানা করা হবে। কোনোভাবেই কৃষিখাতকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।

কৃত্রিম সঙ্কট ও মূল্য বাড়িয়ে সার নিয়ে কারসাজি ব্যবস্থা নিতে ডিসিদের নির্দেশ : কৃত্রিম সঙ্কট ও মূল্য বাড়িয়ে যারা সারের বাজার অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করছে তাদের শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। সারের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে ২২ আগস্ট বিকেলে কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জরুরি বৈঠক থেকে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়। বৈঠকে ভার্চুয়ালি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের যুক্ত করা হয়।

সার সঙ্কটের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সারের বিষয়টি নিয়ে সব জেলা প্রশাসককে মনিটরিং করতে বলা হয়েছে। ডিসিরা এরই মধ্যে জানিয়েছেন কোথাও সারের কোনো সঙ্কট  নেই।

কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, কেউ সারের বাজারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে কি-না সেটি চিহ্নিত করার কাজ চলছে। কেউ শনাক্ত হলে তাদের ডিলারশিপ বাতিল করা হবে।

এদিকে কেউ যাতে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে ও দাম বেশি নিতে না পারে সেজন্য তদারকি জোরদার এবং নিয়মিত  মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম। ২২ আগস্ট বিকেলের বৈঠক থেকে তিনি এ নির্দেশনা দেন। এছাড়া সভা থেকে সচিব জানান, দেশে পর্যাপ্ত সার মজুত রয়েছে, কোথাও সারের সঙ্কট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সভা থেকে বলা হয়, রশিদ ছাড়া যেনো সার বিক্রি না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার  দোকানে লালসালুতে বা ডিজিটালি সারের মূল্য তালিকা টানিয়ে রাখতে হবে। ডিলারের গুদাম ভিজিট করে সারের অ্যারাইভাল নিশ্চিত করতে হবে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কৃষি বিভাগ নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করবে এবং নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। অধিক মূল্যে সার বিক্রির কোনো তথ্য বা সংবাদ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা রিপোর্ট করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ডিলারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সার্বিক বিষয়াদি নিয়ে উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সভাপতিত্বে উপজেলা কৃষি অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ডিলারদের নিয়ে সভা করে কৃষক, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ সবাইকে সারের পর্যাপ্ততা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

সার পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ: দেশে সারের পরিস্থিতি মনিটরিং করতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত ২৮ আগস্ট থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কাজ করবে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। সার বিষয়ক যে কোনো প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। ফোন নম্বর ব্যস্ত থাকলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ  দেয়া যাবে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের নাম ও ফোন নম্বর হলো : কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান শেখ বদিউল আলম (০১৭১৩৫৯৩৪৮৭), গবেষণা কর্মকর্তা মো. নূরুন্নবী (০১৭১৬৪৬২২৭৭), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সার বিষয়ক উপ-পরিচালক আমিনুল ইসলাম (০১৭২৪২৪৫৩৫৪) এবং অতিরিক্ত উপপরিচালক খন্দকার রাশেদ ইফতেখার (০১৮১৪ ৯৪৭০৫৪)।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More